উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুকে এগিয়ে চলছে চন্দ্রদ্বীপ কন্যারা। পাড়ি জমায় তেতুলিয়ার উত্তাল ঢেউ আর ঝড়-তুফানের মতো প্রতিকুলতাকে। চরের অভাবী মানুষগুলো যেখানে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য করছেন, সেখানে সমাজের রক্তচক্ষু, তিরস্কার, কুসংস্কার, শিশুবিবাহের মতো খড়গকে প্রতিহত চন্দ্রদ্বীপ কন্যারা এগিয়ে চলছে উচ্চ শিক্ষার আশায়।
চর মিয়াজান এলাকার ছালাম হাওলাদারের মেয়ে শাহনাজ।
পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনি সাহসী। কলেজে যেতে তাকে প্রতিদিন পাড়ি দিতে হয় প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তাল তেতুলিয়া নদী। নদী-খাল পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নে বাউফলের মূলভূখ- বিচ্ছিন্ন চন্দ্র্রদ্বীপ ইউপির চরমিয়াজানের শাহনাজের মতো প্রতিদিন ছুটতে হয় একই চর ও পাশের চরআলগী, রায়সাহেব ও চরনিমদী থেকে ধানদী ফাজিল মাদ্রাসার, ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজে ইয়াসমিন, সুমী, লামিয়া, শারমিন, মুক্তা, আলেনুর, খালেদা, রীমা, মুন্নি, সুখি, সাথী, সুরমা, ইভা, সালামা, শারমীন, নার্গীস, সীফা, মুক্তা, তানজিলা, রেশমা, সাদিয়া, তানজিলা, মরিয়ম, পারভিন, শিশু শিক্ষার্থী সুস্মিতা, মরিয়ম, মিম, সুমীসহ শতাধিক শিক্ষার্থীকে।
নৌকায় কথা হয় শাহনাজের সঙ্গে থাকা ধানদী ফাজিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী চর মিয়াজানের সুমীর সঙ্গে। সুমী জানায়, খেয়ার নৌকায় এত বড় নদী পাড়ি দিয়ে ক্লাস ধরতে প্রায়ই দেরি হয়। ক্লাস কামাই দিতে হয় ঝড়-তুফান কিংবা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেলে। অল্প-স্বল্প পানিতেও চর তলিয়ে গেলে বাড়ি থেকে খেয়াঘাট আসতেও প্রয়োজন হয় আরো একটি নৌকার। এছাড়া শীতে কুয়াশায় ঢাকা পড়লে মেয়েদের জন্য চরের নির্জন পথও হয় অনিরাপদ। খেয়ায় পাড়ি দিয়ে প্রায়ই ঠিকঠাক কূলে পৌঁছানো যায় না। সুমি বলেন, ‘একবার ঘনকুয়াশার কারণে খেয়ার নৌকা নদীতে দিক হারিয়ে নিমদী ঘাটে না পৌঁছে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে তালতলী ঘাটে চলে যায়। ওই দিন আর ক্লাস ধরা হয়নি নৌকায় থাকা কারোরই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ‘টাকা দিয়ে পার হলেও সঠিক সময়ে ক্লাস ধরতে হবে এমন কোন অনুভূতি কাজ করে না খেয়া নৌকার মাঝি হানিফ হাওলাদারের। নদী পাড় হয়ে ঠিকঠাক ক্লাস ধরা যায় না প্রায় সময়ই।’
কিছু দিন আগে খেয়ার নৌকা উল্টে বড় ধরণের দূর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণির ছাত্রী নার্গীস। সেবারে নদীতে বই-খাতা ভেসে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এত কষ্টে নদী পার অই। হ্যারপর খেওয়া ভাড়াও লাগে মাসে ১শ’ টাহা। চরের ছাত্রছাত্রীগো স্কুল-মাদ্রাসায় পরীক্ষার ফি, বেতন ও অন্যসব টাহা-পয়সা কমাইয়া লওয়া উচিত।’ এসময় নার্গিসের সঙ্গে থাকা দূর্গম এসব চরের শিক্ষার্থীরা দাবি জানান, উত্তর চন্দ্রদ্বীপে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার।
অপরদিকে চন্দ্রদ্বীপের চরওয়াডেলের খেয়ায় পাড় হওয়া কালাইয়া ইদ্রিসমোল্লা ডিগ্রী কলেজ ও বাউফল সরকারি কলেজের একাধিক ছাত্রী খাদিজা, মাকসুদা, শারমিন ও রীপা জানায়, মুলভূখন্ড বিচ্ছিন্ন রায়সাহেবচর, চরমিয়াজান, চরকচুয়া, চরদিয়ারাকচুয়া, চরনিমদী, পাঁচখাজুরিয়া, কিচমত পাঁচখাজিুরিয়া, চরব্যারেট, চরওয়াডেল ও চরআলগী এই দশটি চর নিয়ে নবগঠিত চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের মোট আয়তন ৫৫ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। মোট ভোটার রয়েছে প্রায় ৬ হাজার। প্রস্তাবিত একটি প্রাইমারী স্কুলসহ মোট ৬ টি প্রাইমারী ও ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি হাই স্কুল। তবে দূর্গম হওয়ায় রায়সাহেবচর, চরমিয়াজান, চরনিমদী, পাঁচখাজুরিয়া, কিচমত পাঁচখাজিুরিয়া ও চরআলগীর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় ওই স্কুলে কোনমতেই পৌঁছা সম্ভব হয় না।’ এ কারণেই অবহেলিত উত্তর চন্দ্রদ্বীপের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার সুবিধার্থে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তারা।
এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে চরের মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করা শ্লোভ বাংলাদেশ নামে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প ব্যাবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাউফলের চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন সংস্থা কাজ করছে না। গণশিক্ষার অধিনে শ্রাবণ নামে এক উন্নয়ন সংস্থা এ সম্পর্কিত প্রকল্প হাতে নিলেও কবে নাগাদ তার কার্যক্রম চালু হবে তা ঠিক নেই। উপজেলার মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দূর্গম চন্দ্রদ্বীপের প্রাইমারি স্কুলেও শিক্ষকরা যেতে চায় না। পিয়ন দিয়েও ক্লাস চালানোর কথা চালু আছে। এমন বাস্তবতায় শিক্ষার সুযোগ না পেলে চরের ছেলে-মেয়েরা আরো পিছিয়ে পড়বে।’
এ ব্যাপারে চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাস মোল্লা বলেন, ‘আ. স. ম ফিরোজ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের মেয়েদের এখন আর প্রাইমারি স্কুল শেষে লেখাপড়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয় না। এসএসসি দিতে পারে। দুর্গম দূরত্ব বিবেচনায় উত্তর চন্দ্রদ্বীপে মিয়াজান-রায়সাহেবের চর এলাকায় একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি হয়েছে। একই সঙ্গে কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে চরের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও সহজাত বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে তিনি আরো বলেন, ‘চরের মেয়েদের শিক্ষার প্রতি সরকারের বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় শিশুবিবাহ বন্ধ, মত প্রকাশের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাসহ চরের মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে।