বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকেই সাময়িক কর্মসংস্থান কিংবা পার্টটাইম চাকরি করে থাকেন। দিন দিন বেকারের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
এই বিপুলসংখ্যক বেকারের অধিকাংশই শিক্ষিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার।
একটি দেশের শিক্ষিত জনশক্তি সেদেশের মহামূল্যবান সম্পদ। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষিত জনশক্তি বোঝা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। অনেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তারা সেসব দেশে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। অনেকে আবার নিজ যোগ্যতার চেয়ে নিম্নস্তরের কোনো চাকরি করে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
শিক্ষিত যুবকদের একটি বিরাট অংশ ঝুঁকে পড়ছে মাদক ব্যবসায়। তারা সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। ফলে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হচ্ছে মাদকের আখড়ায়। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে।
কেন আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজের এ অবস্থা? এর জন্য দায়ী আমাদের অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে অনার্স ও মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরির জন্য ভর্তি হতে হয় কোচিং সেন্টারে।
আরও দু’বছর কাটাতে হয় কোচিং সেন্টারের গৎবাধা বুলি, ওরাকল, এমপিথ্রি ইত্যাদি মুখস্থ করে। অতঃপর এই মুখস্থবিদ্যা দিয়ে তাকে চাকরির জন্য যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে হয়। এর ফলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তা, শিক্ষা গবেষণার শিক্ষার্থী হচ্ছে পুলিশ অফিসার, কেমিস্ট্রির ছাত্র হচ্ছে কূটনীতিক। এসব পোস্টে আবার আসন সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। আমরা দেখতে পাই প্রতি বছর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২০০০ পদের জন্য প্রতিযোগিতা করে ৪ লাখ শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ব্যক্তি তার ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখবে। অথচ রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দূরে থাক, তাকে ব্যক্তিজীবনে পরনির্ভর হয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে। শিক্ষা আইন ২০১৬-তে নোটবই, গাইডবই, কোচিং বাণিজ্য ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গাইডবইয়ের ছড়াছড়ি। সারা দেশে কোচিংয়ের রমরমা বাণিজ্য।
আমরা যদি চীনের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ কর্মমুখী। প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে রয়েছে ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের সামগ্রিক উপকরণ। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তৈরি করা হচ্ছে সার্টিফিকেটধারী মেরুদণ্ডহীন, অকর্মা।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হলে ঢেলে সাজাতে হবে আমাদের সেকেলে শিক্ষানীতি। সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে কর্মমুখী শিক্ষাকে। এক্ষেত্রে আমরা চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশকে আইডল হিসেবে ধরে নিতে পারি।
সর্বোপরি শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ বাড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাবাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তুলতে হবে কর্মসংস্থান। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে আমাদের দৈন্যদশা থেকে উত্তরণ। বেকার সমস্যা দূর হবে। দেশ হবে সমৃদ্ধ। অর্জিত হবে ২০৪১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এমএ) মাদ্রাসা
সৌজন্যে: যুগান্তর