একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের উন্নতির মূল শেকড় হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে গবেষণা করে উদ্ভাবনীয় শক্তি বৃদ্ধির ফলে একটি দেশ উন্নতির শীর্ষে পৌছাতে সক্ষম হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশ উন্নতির শীর্ষে পৌঁছার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এক দেশ অন্য দেশকে ডিঙিয়ে যাওয়ার জন্য নিত্যনিতুন আবিষ্কার করছে। আবিষ্কার যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের গবেষণা ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে। এদিক দিয়ে আমেরিকার পরেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে চীন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামীতে চীনের অর্থনীতি আমেরিকাকে অতিক্রম করবে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, চীনের এই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সমৃদ্ধ গবেষণা খাত। আর গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করছে চীনের ‘সহস্র মেধাবী প্রকল্প’। ২০০৮ সালে গৃহীত প্রকল্পটির ফলে চীনের ভাগ্যাকাশে অতি অল্পসময়ে উন্নতির জোয়ার বইছে। বলা হয়ে থাকে, বর্তমানে চীন ‘জ্ঞান’ ছাড়া অন্যকিছু কারও থেকে ধার করে না। আমেরিকার তৈরি ফেসবুক, ইউটিউবও তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করে না। নিজেরাই নিজেদের জন্য এসব তৈরি করেছে। চীন সারা দুনিয়ায় তাদের নাগরিকদের পাঠায়। পুরো দুনিয়া থেকে তারা শেখে, জ্ঞানার্জন করে। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি তরুণ গবেষক পাঠায় যে দেশটি, সেটি হল চীন।
প্রতিবছর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১০ হাজার চীনা ছেলেমেয়ে আমেরিকায় যায় গবেষণা করার জন্য। তারা সব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে; গবেষণায় অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিক্ষার্থী গবেষণার পাশাপাশি গবেষণার যত ডিজাইন, অ্যারেঞ্জমেন্ট, টুলস-টেকনিক আছে, সেগুলো স্ক্যান করে। চীন সহস্র মেধাবী প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণারত মেধাবী ছেলেমেয়েদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ফিরিয়ে নিয়ে তাদের হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়। ফলে তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণায় রত থাকেন। সত্যি, কী দূরদর্শী ও টেকসই পরিকল্পনা তাদের!
এদিকে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই বললেই চলে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, শত শত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে বিশেষ কোনো ফায়দা হচ্ছে না। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে গবেষণার জন্য গেলেও অধিক সুবিধা পাওয়ার ধরুন ছুটি শেষ হলেও দেশে ফিরে আসছে না। ফলে গবেষণা খাত সমৃদ্ধ হচ্ছে না। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৫টি। এর মধ্যে ৩৭টিতে ২ হাজার ৯৪০ শিক্ষক অন্তত ৫ ধরনের ছুটিতে আছেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে ২ হাজার ১০১ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে।
প্রেষণ বা লিয়েন নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৮৪ জন, বিনাবেতনে ছুটিতে আছেন ৫৮ জন, ছুটি শেষ হওয়ার পরও অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন ১৭ জন এবং খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন ৬৮০ জন। এছাড়া অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এনজিও ব্যবসা, বিদেশি সংস্থায় পরামর্শকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন আরও ৫ শতাধিক। সব মিলিয়ে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজারের বেশি শিক্ষক বিচ্ছিন্ন আছেন পাঠদান কার্যক্রম থেকে।
মেধাবীরা নিত্যনতুন আবিষ্কার করেন আর মেধাবীদের তৈরি করেন শিক্ষক। তাদেরকে ‘কারিগরের কারিগর’ বলা হয়। তারা নিজেরা গবেষণা করবেন এবং শিক্ষার্থীদের সেই পথে পরিচালিত করবেন, এমনটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এমনটা হচ্ছে না। কিছু দায়িত্ববান শিক্ষক আছেন, যারা প্রতিনিয়ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। এই অল্পসংখ্যক মানুষের ওপর ভর করে একটি দেশ এগোতে পারে না। ফলে উন্নয়নের পথে প্রতিনিয়ত হোঁচট খেতে হচ্ছে।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এবং গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য চীনের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। যে দেশটি সারা দুনিয়া থেকে শেখে এবং আগামীতে যারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের থেকে আমরা প্রচুর জ্ঞান-বিজ্ঞান নিতে পারি। এছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির মতো আমাদের শিক্ষাচুক্তিও থাকতে পারে। চীনের মতো আমাদেরও দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিদেশে গবেষণারত দেশের সব গবেষককে অনতিবিলম্বে দেশের স্বার্থে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তা না হলে প্রতিযোগিতামুখর বিশ্ব অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমরা থেকে যাব অনেক পেছনে।
লেখক: ফয়সাল মাহমুদ আল-মারজান, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়