পুলিশ কি কোনোদিন মানুষের চিন্তাও খুঁজে দেখবে- সেখানে কোনো চিন্তাজনিত অপরাধ আছে কি না। ‘থট পুলিশ’ নামে কাল্পনিক একটা পুলিশের কথা আমরা জানতে পারি জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘১৯৮৪’-এ। যাদের কাজ মানুষের চিন্তা থেকে ‘থট ক্রাইম’ খুঁজে বের করে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) যুগান্তর প্রত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন জাহেদ উর রহমান।
সাম্প্রতিককালের একটা খবর আমার মনে সন্দেহ তৈরি করছে- আমাদের রাষ্ট্রটির অভিমুখ সেদিকেই সম্ভবত। ভুল হোক বা সত্য হোক আমরা যখন কোনো একজন মানুষকে প্রথমবার দেখি, তখন তার সম্পর্কে আমাদের এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়। এটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার নয়, বলাই হয় ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন’।
এটা নিয়ে অনেকে বিতর্ক করেন; কিন্তু ফার্স্ট ইম্প্রেশন নিয়ে পরে যে কথাটা তৈরি হয়েছে সেটা নিয়ে আশা করি কেউ বিতর্ক করে না- ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ লাস্টিং ইম্প্রেশন।
আমার চুল লম্বা। লম্বা চুলও ‘বখাটে কাটিং’ কি না জানি না, তবে এটাও সমাজের দৃষ্টিতে খুব ভালো কিছু নয়। এমনকি আমার মা-ও এই চুল রাখা পছন্দ করেন না। ভুল হোক বা ঠিক, লম্বা চুলও মানুষকে এক ধরনের ধারণা দেয়।
এ ধরনের স্টেরিওটাইপ ধারণা সমাজে নানা কারণে হতে পারে। সেই আলোচনার জায়গা এটা নয়। তবে এটা সবার মনে রাখা দরকার, এটা যেহেতু এক ধরনের স্টেরিওটাইপিং, এর মধ্যে চরম ভ্রান্তিও আছে।
চুল দিয়ে যদি কাউকে বখাটে বা খারাপ নির্ধারণ করা হয় তাহলে এই রাষ্ট্রের ব্যাংক থেকে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটকারী, সমাজটাকে মাদকে ভরিয়ে দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করা মানুষ, এরা কেউ বখাটে নয়, এদের সবার চুল ‘সাধু কাট’ দেয়া, কিংবা অনেকের ‘কাট’ দেয়ার মতো চুলও নেই মাথায়।
একটা সমাজে কিশোর-তরুণরা কেমন চুলের স্টাইল রাখবে সেটা নিয়ে সমাজে আলোচনা হতেই পারে। প্রত্যেক মানুষ তার মতো করে মতামত দিতেই পারেন। সেই আলোচনা চলুক এবং সেটা থেকে যে কোনো সত্য বেরিয়ে আসুক, এটা সমাজের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
মাগুরা জেলার পুলিশ সম্প্রতি কিশোর-তরুণদের চুল কাটার ক্ষেত্রে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে ব্যাপক মাইকিং, সেলুনকর্মীদের নিয়ে বৈঠকসহ নানা রকম প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সেলুন মালিকদের জানানো হচ্ছে, কোনো সেলুনকর্মী কারও চুল কিংবা দাড়ি যেন মডেলিং ও বখাটে স্টাইলে না কাটেন।
মডেলিং এবং বখাটে স্টাইল কাকে বলে সেটার এক ধরনের ধারণাও দিয়েছে পুলিশ। সেটা হল- একশ্রেণির যুবক চুল এমনভাবে কাটে, তাদের দুই কানের উপরের অংশে চুল থাকেই না। কিন্তু মাথার উপরের অংশে ঘন চুল থাকে। এই চুল বেশ দীর্ঘ হয়।
হাঁটার সময় কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় এ চুল বাতাসে দুলতে থাকে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যেই সেলুনে সেলুনে সেই বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেন এ ধরনের পদক্ষেপ তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে পুলিশ। ওসি বলেন, ‘মানুষের লাইফস্টাইলের সঙ্গে তার আচরণের নানা যোগসূত্র রয়েছে। অনেকে উদ্ভট পোশাক পরে ও উদ্ভট স্টাইলে চুল কাটে, যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক।
সেটি তার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই ফেলবে। এ কারণে এটি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে সবার আগে জরুরি সচেতনতা। সে কাজটিই আমরা করছি। ইতিমধ্যে এর ইতিবাচক ফলও পাচ্ছে শহরবাসী।’
সারা দেশে এটি নিয়ে নেটিজেনরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন ফেসবুকে। অবিশ্বাস্যভাবে এ আদেশ প্রত্যাহার করার কোনো খবর এখনও আমরা দেখিনি। শেষ পর্যন্ত এ আদেশ প্রত্যাহার করা হবে হয়তো।
কিন্তু দিনের পর দিন একটা জেলা পুলিশ এ কাজটা করতে পেরেছে এবং সেই সিদ্ধান্ত তারা বহাল রেখে সেটার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে- এর মানে হল এ পুরো প্রক্রিয়ায় এ রাষ্ট্রের এক ধরনের সায় আছে। এটাই ভয়ংকর ব্যাপার।
মাগুরার ঘটনাটির পর বগুড়ায় ঘটেছে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা। পার্কের ভেতরে গিয়ে অভিযান চালিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এভাবে আটক করে থানায় নেয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠলেও বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনা শুধু বগুড়ায় ঘটেছে তা নয়, অন্য জায়গা থেকেও একই ধরনের ঘটনা ঘটার রিপোর্ট আমরা দেখেছি।
স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস শেষে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিল, কেউবা বন্ধুর কাছ থেকে নোট নিতে সেখানে গেছে; কিন্তু তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া গেছে এ অভিযোগে।
কিন্তু ওই রিপোর্টেই অভিযানে অংশগ্রহণ করা এক পুলিশ সদস্যের বক্তব্য এরকম- আটক ছেলেমেয়েরা পার্কে বন্ধুর পাশে বসে ও দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কারও আচরণই আপত্তিকর ছিল না।
পুলিশ এখানে কোনো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নয়। পুলিশ সেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের চিন্তার প্রতীক। তাই অরওয়েল যখন থট ক্রাইম আর থট পুলিশের কথা বলেন, তিনি আসলে বলতে চান রাষ্ট্র মানুষকে এমনই সার্ভেইলেন্সের আওতায় আনতে চাইছে যে, রাষ্ট্র মানুষের চিন্তাও খুঁজে দেখতে চায়।
এটি নিয়ে কোনো তর্ক নেই যে সবচেয়ে মানবিক রাষ্ট্রটিও একটা নিষ্পেষণমূলক বলপ্রয়োগকারী সংগঠন। সে জন্যই আধুনিক রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর থেকে নাগরিকদের ক্রমাগত চেষ্টা ছিল নাগরিকদের জীবনের কতটুকু এলাকায় রাষ্ট্র প্রবেশ করতে পারবে, তার একটা চৌহদ্দি ঠিক করে দেয়া।
মানুষের ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্র কতটুকু ঢুকতে পারবে সেটা একটা রাষ্ট্রের টোটালিটারিয়ানিজমের পথে হাঁটার সঙ্গে সমানুপাতিক। যে রাষ্ট্র অনেক বেশি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করে, সেই রাষ্ট্র আসলে টোটালিটারিয়ান হওয়ার পথে এগিয়ে যায়।
এই যে আজ একটা বিশেষ ধরনের চুলের কাটকে বখাটে কাটিং নাম দিয়ে সেরকম চুলের কাট না দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, অহেতুক পার্ক থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ছোট ঘটনা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটা আসলে প্রমাণ করে এ রাষ্ট্র মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে অনধিকার প্রবেশ করছে।
সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ওপর সার্ভেইলেন্স এবং নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস আমাদের দীর্ঘকাল থেকেই ছিল। কিন্তু এখন এটা যেভাবে একেবারে অতি সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ বিষয়ে এসে ঠেকেছে এমনটা আর কখনও ছিল না। এর মানে রাষ্ট্র এখন তার অতি সাধারণ নাগরিককেও আস্থায় নিতে পারছে না। তাই পদে পদে রাষ্ট্র তার নিজের অস্তিত্ব নাগরিকদের জানান দিতে চাইছে।
এটা খুব ভয়ংকর একটা উপসর্গ, এটা রাষ্ট্রের টোটালিটারিয়ানিজমের পথে হাঁটার লক্ষণ। থাকবে না নাগরিকদের ন্যূনতম স্বাধীনতাও। তাই প্রতিবাদ হওয়া উচিত খুব দ্রুত, খুব শক্তিশালী। এটা একটা নিরন্তর সংগ্রামের ব্যাপার। এ সংগ্রামটা চালু না রাখলে রাষ্ট্র ক্রমাগত নাগরিকদের ব্যক্তিজীবনের এমন সব এলাকায় ঢুকে পড়তে যে চাইবে, এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রের অধিকারের চৌহদ্দির মধ্যে পড়ে না।
জাহেদ উর রহমান : সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট