দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার একমাত্র উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর-পূর্বে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে প্রায় ২০ কিলোমটার দূরে এক মনোরম পরিবেশে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলি ইউনিয়নের চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের পাশে উনসত্তরপাড়া মৌজায় প্রায় ১৭১ একর জায়গা জুড়ে চুয়েট ক্যাম্পাসের অবস্থান। মূল শহর থেকে অদূরে গ্রামীণ জনপদে অবস্থান ও বহুবিধ সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে চুয়েট নিভৃতেই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে। দেশে-বিদেশের প্রকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চুয়েটের ছেলেমেয়েদের সাফল্য ও দক্ষতা অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। বিশ্ববিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, গুগল-ফেসবুকের মতো বৈশ্বিক জায়ান্ট তথ্যপ্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান করে নেওয়া ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রতি বছর নিয়মিতভাবে একাধিক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন, দেশি-বিদেশি স্কলার ও গবেষকদের অংশগ্রহণে সেমিনার-কর্মশালা-সিম্পোজিয়াম আয়োজন, বিশ্বমানের ল্যাব ও যন্ত্রপাতি সংযোজন, রোবট গবেষণায় যুগান্তকারী উদ্ভাবন, কর্ণফুলী ও হালদা নদী-সম্পর্কিত গবেষণা, বহুবিধ শিল্পসমস্যার সমাধান, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ সেবা প্রদান এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভূমিকম্প, পরিবহন-যানজট, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ সমস্যাবিষয়ক জনগুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবোরেশন, বিভিন্ন খ্যাতনামা জার্নালে নিয়মিত গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ, বহির্বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা-গবেষণায় সমঝোতা চুক্তি গড়ে তোলা প্রভৃতি চুয়েটের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, মনোমুগ্ধকর এই ক্যাম্পাসে একই সঙ্গে পাহাড়, সমতলভূমি ও প্রাকৃতিক লেকের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যেই দেশের একমাত্র খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী বহমান। আর ঘণ্টাখানেকের দূরত্বেই ৩৩ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদু পানির কাপ্তাই হ্রদ। কাপ্তাই হ্রদ ও কর্ণফুলীর তীরবর্তী সমভূমি হওয়ার সুবাদে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পুরোটাই আছড়ে পড়েছে এই ক্যাম্পাসে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি অনুষদের অধীনে ১৮টি বিভাগের পাশাপাশি তিনটি গবেষণা ইনস্টিটিউট, তিনটি গবেষণা সেন্টার ও একটি কেন্দ্রীয় ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি (BRTC) রয়েছে। সেন্টারটির মাধ্যমে সারাদেশে বিবিধ শিল্প এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিসংক্রান্ত সেবা ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। চুয়েটে রয়েছে দেশের একমাত্র ভূমিকম্প প্রকৌশল গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ’। দেশের রোবটিক চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তীর্থস্থান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। গত দেড় যুগ ধরে চুয়েটের রোবটিক গবেষণাধর্মী সংগঠন ‘রোবো মেকাট্রনিকস অ্যাসোসিয়েশন’ (আরএমএ), ‘অ্যান্ড্রোমেডা স্পেস অ্যান্ড রোবটিকস রিসার্চ অরগ্যানাইজেশন’ (অ্যাসরো) এবং ‘মঙ্গল অভিযাত্রিক-৭১’ সংগঠনগুলো দেশব্যাপী রোবটিক চর্চা ও উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। রোবটিক চর্চার সেই সফলতার গল্প সুদূর বিশ্ববিখ্যাত নাসা পর্যন্ত দ্যুতি ছড়িয়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত নাসা, গুগল ও ফেসবুক জুড়েও চলছে চুয়েটের শিক্ষার্থীদের দাপট। ২০১৩ সালে বিশ্ববিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা আয়োজিত ‘লুনারোবটিকস মাইনিং কম্পিটিশন’-এর বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শায়েখ আহমেদ, রিফাত মাহমুদ, নাহিন বাহার চৌধুরী ও রিনি ঈশান খুশবুদের তৈরি ‘লুনারবট’। সম্প্রতি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইয়ামিন ইকবাল বিশ্বের সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
ভূমিকম্প, জলাবদ্ধতা, ভূমিধস ও পরিবহন-যানজটবিষয়ক গবেষণায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের ভূমিকা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনসাধারণের আস্থা তৈরি করে নিয়েছেন। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিরোধ ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি এবং জাতীয় স্থাপনা নির্মাণকালে মাটির গুণাগুণ (সয়েল টেস্ট) নিরীক্ষার জন্য চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিদগণ নির্ভরতার প্রতীক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
চট্টগ্রামের লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী ও হালদা নদীর দূষণ, নাব্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ পরিবেশবিষয়ক নানাবিধ গবেষণা সচেতনমহলে প্রশংসিত হয়েছে। হালদা নদীতে টেনারিশিল্পের বর্জ্যে ভস্ম ছাই ও সক্রিয় কার্বনের যৌথ সক্ষমতা যাচাই, কর্ণফুলী ও হালদা নদীর মত্স্য সম্পদ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহের পরিমাণ নির্ধারণ এবং নদীগুলোর মধ্যে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে গত ৪০ বছরে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল হ্রাস, কক্সবাজার ও তত্সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় নতুন করে ভূমি জেগে ওঠার মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট গবেষণা ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
প্রকৌশল শিক্ষা অন্যান্য শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ব্যতিক্রম হওয়ায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সারা বছরই আঁটোসাঁটো একাডেমিক শিউিউলের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তাই বলে চুয়েটিয়ানরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দমে থাকতে পারে না। শুনে অবাক হতেও পারেন যে, চুয়েটের ১৭১ একরের ভূমিতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ১৮-২০টি।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টি, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে চুয়েটে ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ স্থাপনের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাফল্যের ধারায় নতুন পালক যুক্ত করেছে। চলতি বছরের শেষ দিকে চুয়েট ক্যাম্পাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ একর জমির ওপর ১০ তলা ভবনবিশিষ্ট বহুল প্রতীক্ষিত ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ স্থাপন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় চুয়েটে প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর একটি ‘চুয়েট আইটি পার্ক’ নির্মাণের কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া অত্যধিক মোবাইল অ্যাপস ল্যাব ও রোবটিকস ল্যাবরেটরি আরো দুটি নির্মাণ করা হবে। এ দুটো প্রকল্প সমাপ্ত হলে চুয়েট হয়ে উঠবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরির কারখানা। যা বাংলাদেশকে আগামী দিনের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম : জনসংযোগ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।