ছবিসমৃদ্ধ বই শিক্ষার্থীদের কতটা কাজে আসে - দৈনিকশিক্ষা

ছবিসমৃদ্ধ বই শিক্ষার্থীদের কতটা কাজে আসে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের সর্বোচ্চ মঙ্গল কামনা করি। তারা জীবনে যা হতে চায় তাই যেন হয়, সেই আশা করি। কিন্তু আমরা সমাজের চাপের কাছে প্রায়ই নতি স্বীকার করি এবং শিশুদের মানসিক বৃদ্ধি রোধের জন্য সমাজে প্রচলিত যে বাধাগুলো বিরাজমান সেগুলো রোধের চেষ্টা করি না বরং সহজেই মেনে নিই। যেমন শিশুদের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহণের চেয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ফল বৃদ্ধির জন্য প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিই। সোমবার (৮ জুলাই)  যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধনে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন মাছুম বিল্লাহ।

সেখানে তাদের ক্রিয়েটিভিটি থাকুক আর না-ই থাকুক। আর তাই অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিই। এমন সব বই ক্রয় করি যেগুলো তাদের ক্রিয়েটিভিটিকে জাগ্রত করে না, বরং কমায়। আমরা তাদের এমন সব বিদ্যালয়ে পাঠাই যেগুলো শুধু পরীক্ষানির্ভর, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলনির্ভর এবং ব্যয়বহুল।

বইয়ের ভারে শিক্ষার্থীদের ন্যুব্জ করে ফেলি। ছবি ও ইলাসট্রেশনের বই যা তাদের কল্পনাশক্তিকে বৃদ্ধি করে সেগুলো পড়াই না, এগুলোর ওপর জোরও দিই না। এ ধরনের পাঠ বা পুস্তকের দিকে তাদের আকৃষ্ট না করিয়ে কীভাবে পরীক্ষায় শুধু গ্রেড পেতে পারে সেদিকেই নজর দিই।

ছবিসমৃদ্ধ একটি বইয়ের চিত্রগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের বুঝতে সাহায্য করে যে তারা কী পড়ছে এবং তাদের চেয়ে বড় শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে ছবির মাধ্যমে প্রকাশিত গল্প বা বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে।

তারা যখন কোনো বিষয় বা গল্প বুঝতে সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রদত্ত ছবি কথা বলে এবং শিক্ষার্থীরা তখন অনেক সহজেই সেখানকার মেসেজ বুঝতে পারে। ইলাসট্রেশন বিদেশি ভাষায় লিখিত কোনো কিছু শিক্ষার্থীদের জন্য বুঝতে পারার একটি শক্তিশালী পন্থা।

এভাবে আমরা যেহেতু বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি পড়ছি, তাই ইংরেজিতে লিখিত কোনো বিষয় বুঝতে অনেক সহজ হয় যদি সেখানে ছবি থাকে। শিশুরা আর্ট/কলা পছন্দ করে। আর এ জন্যই তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে রং করা, ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

ছবিসমৃদ্ধ বই ভাষার শব্দ অনুশীলন করতে সহায়তা করে। বাবা-মা বা অভিভাবক হিসেবে এটি আমাদের দায়িত্ব যে, তাদের প্রতিটি নতুন বিষয়ের সঙ্গে, আকর্ষণীয় বস্তুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। ছবির এক ধরনের রিদম বা সুর আছে, রাইম বা চরণ আছে এগুলো শিশুদের শব্দ করে পড়তে সহায়তা করে। আর তখন তারা এ বিষয়গুলো শিখে ফেলে, উচ্চারণ শিখে ফেলে।

কোনো ছবির বইয়ে কোনো বিষয়ের পুনর্ব্যক্তি শিক্ষার্থীকে ছবির মাধ্যমে গল্প ও অর্থ প্রকাশে অংশগ্রহণ করতে সহায়তা করে। বাচ্চাদের চেয়ে বেশি বয়সী শিক্ষার্থীরাও উত্তেজিত হয়ে ওঠে যখন তারা ছবির মাধ্যমে বুঝতে পারে সামনে কী হতে যাচ্ছে এবং তখন উচ্চারণসংক্রান্ত সচেতনতা ফনিমিক অ্যাওয়ারনেস, ফনিক্স কম্প্রিহেনশন এবং ফ্লুয়েন্সি বা দ্রুততার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে।

ছবিসমৃদ্ধ পুস্তক বহুবিধ সংবেদাত্মক (multi-sensory) যা শিশুদের মনকে বিকশিত করে এবং তাদের কল্পনায় নাড়া দেয়। তারা তখন শুধু কান দিয়ে গল্পটি শোনে না, তারা তখন ইলাসট্রেশন দেখে, গন্ধ নিয়ে বুঝতে পারে, বইয়ের পাতা ছুঁয়েও বিষয় বুঝতে পারে।

ছবির বই বা বইয়ের ছবি একটি সাহায্যকারী যন্ত্র বা টুল- কারণ ও ফলের (কস অ্যান্ড ইফেক্ট) ধারণা শিখনের ক্ষেত্রে। বাচ্চাদের ছবির বই পড়ে শোনানোর আগে তাদের মূল শব্দগুলো অর্থাৎ কি-ওয়ার্ডগুলো শোনাতে হবে। ছবির বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে গল্প তৈরি করার অনুভূতি জাগায়।

তারা গল্পের শুরু, মধ্যভাগ ও শেষভাগ জানতে পারে এবং বয়সোপযোগী বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং এগুলোর মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

ছবি পুরোপুরি ভিন্নভাবে, অধিকতর ইন্টারঅ্যাকটিভ কমিউনিকেশন গড়ে তুলতে পারে শিশু ও বাবা-মায়ের মধ্যে। তাদের মধ্যে ছবি, গল্প ও শব্দ ইত্যাদি নিয়ে কথা হতে পারে যার অর্থ হচ্ছে এক ধরনের ইন্টারঅ্যাকশন যা রিডিং কম্প্রিহেনশনকে অধিকতর উন্নত করে। ছবির বই ছবিতে আমরা কী দেখছি তা বলার সুযোগ দেয়, কী দেখেছি, কী ছিল আগে, কী হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়েও কথা হতে পারে যা কল্পনাশক্তিকে নাড়া দেয়।

ছবির বই অদ্বিতীয় সাহিত্যিক কাঠামো উপস্থাপন করে যেখানে গল্প শিল্পের সঙ্গে মিশে যায়। এখানে গল্প ও ছবির ইলাসট্রেশন এত গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দুটো বিষয়ই গল্প বলতে সহায়তা করে। ছবির বই পড়া বা দেখা মানে শিল্প ও কলা আবিষ্কার করা। যদিও কোনো বইয়ের কাভার দেখে বইটিকে বিচার করা যায় না, তবে শিশুরা প্রথমেই বইয়ের কাভার দেখে বই পছন্দ করে।

অতএব, চমৎকার ইলাসট্রেশন দিয়ে শিশুদের আকর্ষণ করা উচিত যাতে তারা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বইয়ের প্রতি এ ভালোবাসা তাদের চিরদিনের জন্য আটকে রাখে। এমনকি বই পড়তে পাড়ার আগ থেকেই শিশুরা বইয়ের ছবির সঙ্গে কথা বলে, সাড়া দেয়।

বয়স্কদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যে বইয়ে ইলাসট্রেশন আছে সেই বইগুলো অন্যগুলোর চেয়ে বেশি পড়ে। কারণ এখানে মজা আছে এবং সহজেই বোঝা যায়। তা ছাড়া অনেক লম্বা সময় পড়ার মধ্যে ছবি দেখা এক ধরনের বিরতি, কাজেই এটি আকর্ষণীয় এবং অ্যাপিলিং।

ছবি শিশুদের কল্পনার রাজ্য আবিষ্কার করতে সহায়তা এবং বইয়ের বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। আর শিশুদের এগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া মানে বইটির ঘটনাবলী তাদের কাছে বাস্তবে দেখানো।

সচিত্র বই পাঠকদের সামনে বিশেষ অর্থ প্রকাশ নিয়ে হাজির হয় এবং অনেক তথ্য বহন করে। কোনো কৃষি খামারে যাওয়ার ছবি, কোথাও ভ্রমণে যাওয়ার ছবি, চিড়িয়াখানার ছবি একটি শিশুকে দেখানো হলে শিশুটি সেখানে না গিয়েও অনেক তথ্য পেতে পারে, স্থানটি সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা নিতে পারে এবং এ ধারণাগুলো ভবিষ্যৎ জীবনে বহু কাজে লাগে। তাদের নতুন ধারণা, নতুন কোনো কিছু মানুষ এবং ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

এগুলো তাদের নতুন পরিবেশ ও বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করতে এবং জানতে সহায়তা করে এবং এভাবে জানাই তার প্রকৃত জানা, মুখস্থনির্ভর জানা নয়। কোনো বিষয় সম্পর্কে তারা ব্যাকগ্রাউন্ড ধারণা লাভ করতে পারে।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে যেটি হয় তা হল কোনো বিষয় সম্পর্কে ক্রিটিক্যালি কোনো কিছু চিন্তা করতে সহায়তা করে। ছবি দেখে তারা অনুমান করতে পারে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে পারে। ছবি ব্যবহার করে তারা বাচ্চাদের বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে, কোনো বিষয়ের ক্লু দিতে পারে যা ছবি ছাড়া সম্ভব নয়।

ছবি সংবলিত বই বয়স্ক ও শিশুদের মাঝে ইন্টারঅ্যাকশনের এক চমৎকার সুযোগ করে দেয়। এটি জীবনব্যাপী বইয়ের প্রতি ভালোবাসার আর একটি ক্রিটিক্যাল উপাদান। একটি শিশু কী পছন্দ, কী অপছন্দ করে সচিত্র বই তাদের সামনে উপস্থিত করলে এবং বইয়ের প্লট সম্পর্কে তাকে বলা হলে আমরা শিশুর অনেক সাইকোলজিক্যাল বিষয় সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। ছবির বই শিক্ষার্থীদের ভিজ্যুয়াল থিংকিং স্কিল বাড়ায়।

তারা ছবিতে যা দেখে তার সঙ্গে বাস্তব জগতের অনেক কিছুর সঙ্গে, কারণের সঙ্গে, ধারণার সঙ্গে মেলাতে পারে। ছবির বই শিশুকে আর্ট বা শিল্পকে ভালোবাসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যা একটি শিশুকে আর্ট গ্যালারিতে নিয়ে গেলেও সে অর্জন করতে পারে না। বইয়ের ইলাসট্রেশন বা সচিত্র বই শুধু এক ধরনের ডেকোরেশন নয়, এগুলো বরং গল্পের ঘটনাকে ও আবেগকে আরও শক্তিশালী করে। কীভাবে মনোযোগী শ্রোতা হতে হয় তা ছবির বই আমাদের শেখায়।

ক্যান্ডেলউইক প্রেসের কারেন লস বলেছেন, ছবি থেকে ছবির বই যখন একজন পাঠক দেখে এবং পড়ে তখন অজানা ও অদেখা বস্তু দিয়ে তার কল্পনার রাজ্য ভর্তি হয়ে যায় অর্থাৎ তাকে ক্রিয়েটিভ করে।

ছবির বই শিশুদের মনে এমনভাবে নাড়া দেয় যা শুধু শব্দ করে বই পড়ে সম্ভব হয় না, এ কথা বলেছেন জে. রিচার্ড জেনট্রি নামে একজন মনস্তত্ত্ববিদ। শিশুদের পাশে যখন বড়রা থাকে না কিছু বলে দেয়ার জন্য, বুঝিয়ে দেয়ার জন্য তখন ছবিই তাদের সঙ্গে কথা বলে, ছবিই অনেক সময় তাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়। ছবিই শিক্ষার্থীদের মধ্যে লেখা দক্ষতার বীজ বপন করে। ছবির মাধ্যমে বই পড়া এক ধরনের মজা, এক ধরনের আনন্দ, এক ধরনের কৌতুক।

ছবির বই পড়া এক ধরনের আরামদায়ক অবস্থা এবং স্বস্তির কারণ। আর আনন্দের মধ্য দিয়েই তো শিক্ষা অর্জন করতে হয় এবং করাতে হয়।

লেখক: সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0083780288696289