কয়েকদিন আগে এক অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর মন্তব্য করেছিলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ থাকা জরুরি।' তার মন্তব্য নিয়ে জনমত জরিপ চালিয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিক। গত ৭ জুলাই প্রকাশিত ওই জরিপে অভিমতদাতাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ লোক মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। ৩১ দশমিক ১৩ শতাংশ 'না' বলেছেন আর ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ পাঠক কোনো মন্তব্য করেননি। পত্রিকাটির অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বিষয়টির প্রতি সমর্থন এ বিষয়ে বাস্তবতারই প্রতিফলন। সংস্কৃতিমন্ত্রীর উপলব্ধিতে যেটা এসেছে, তা যে এ দেশের সচেতন মানুষদেরও মনের কথা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত দেশের রাজনীতির হাল-হকিকত, বিশেষত ছাত্র রাজনীতির দৈন্যদশা দেখে অনেকেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজন তীব্রভাবেই অনুভব করছেন। 'পুনরুজ্জীবন' বলা হলো এ জন্য যে, নব্বই দশকের পর এ দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। কিছু কলেজে হলেও তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। ফলে ছাত্র সংসদ নামের সংগঠনটি যে বর্তমানে মৃতাবস্থায় রয়েছে, তা নিয়ে বোধ করি কেউ বিতর্কে যেতে চাইবেন না।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। স্বাধীনতাপূর্ব থেকেই ছাত্র রাজনীতি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশ ও জনগণের স্বার্থসংশ্নিষ্ট দাবি-দাওয়া নিয়ে এ পর্যন্ত যত গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং সফলতা পেয়েছে, তার সব কয়টির পেছনেই নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে ছাত্র আন্দোলন তথা ছাত্র রাজনীতি। আর সে ছাত্র রাজনীতি সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। ছাত্রছাত্রীদের ভোটে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ সংশ্নিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যেমন মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করত, তেমনি জাতীয় স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রাখত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে আজ যারা জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে শীর্ষস্থানীয় বিশেষণে ভূষিত, তারা বেশিরভাগই এক সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং কেউ কেউ ছিলেন কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি কিংবা জিএস।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি, জিএসের একটা আলাদা কদর সব সময়ই ছিল সংশ্নিষ্ট এলাকায়। সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণাটি ছিল যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি-জিএসরা সচেতন ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত। তাই তারা সৎ, যোগ্য এবং অবশ্যই মেধাবী। ফলে এলাকায় তাদের একটি অবস্থান তৈরি হয়ে যেত। স্থানীয় ব্যক্তিরা সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যায় ভিপি-জিএসের দ্বারস্থ হতেন। সমাধানও পেতেন। ফলে নিজস্ব নেতৃত্বের গুণে ওই ভিপি-জিএসদের অনেকেই স্থানীয় রাজনীতিতে জায়গা করে নিতেন।
অনেকেই বলে থাকেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নেতৃত্ব সৃষ্টির সূতিকাগার। কথাটি যথার্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই। অবশ্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেউ যদি এর বিরোধিতা করেন, তাহলে সে পক্ষেও যুক্তির খুব একটা অভাব হবে না। বলতে পারেন এই যে প্রায় তিন দশক হতে চলল দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না, তাতে কি আমাদের রাজনীতি অচল হয়ে গেছে, নাকি নেতৃত্বের কোনো সংকট সৃষ্টি হয়েছে? না, তা হয়নি। রাজনীতিও অচল হয়নি, আর নেতৃত্বের সংকট তো দূরের কথা, নেতার পরিমাণ এত বেশি হয়েছে যে, এখন কর্মী খুঁজে পাওয়া ভার। গ্রাম-গঞ্জ-শহর যেখানেই যাবেন রাস্তার দু'পাশে দেখতে পাবেন 'নেতা'দের ছবিসংবলিত ফেস্টুনের বাহার। ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড কমিটির একজন সদস্যও নিজেকে নেতা বলে জাহির করে শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবি ব্যবহার করেন। আর এসব নেতার দাপট যে কত প্রচণ্ড, তা তাদের কাছাকাছি থাকা মানুষরাই উপলব্ধি করতে পারেন। বিশেষত, ক্ষমতাসীন দলের হলে। 'বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়' কিংবা 'সূর্যের চেয়ে বালু তপ্ত' বলে যে প্রবাদ বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে, তার সার্থক উদাহরণ হতে পারে এসব নেতা।
এরা রাজনীতি কতটুকু জানে বা বোঝে তা কেউই নিরূপণ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। বইপত্রের কাছে এরা ঘেঁষে না। রাজনীতি যে একটি পরিশীলিত চর্চার বিষয়, পড়াশোনার বিষয়, তা এসব তথাকথিত ছাত্রনেতাদের বোধের মধ্যে নেই। এদের সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ফলে বই তাদের কাছে পরিত্যাজ্য। এদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়- 'বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়েছ কি? আপনি শিওর থাকতে পারেন, দু'দিকে মাথা নেড়ে বলবে- জি না। আবার যদি আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেন- 'কি হে বাপু, খুব তো জিয়ার ১৯ দফার কথা বলছ। তা দুয়েকটি দফার ব্যাখ্যা দাও তো।' দেখবেন সে চুপচাপ আপনার সামনে থেকে চলে যাবে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাদের দ্বারা গড়ে উঠবে, তাদের এ অবস্থা জাতির জন্য অশনিসংকেত নয় কি?
অনেকে যুক্তি দিতে পারেন, ছাত্র সংসদ না থাকলে সমস্যা কী? আমাদের দেশে কি নেতার অভাব? জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থীর কি কোনো সংকট আছে? একেকটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন দৌড়ে শত শত মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে। একটি সংসদীয় আসনে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের হালি-দেড় হালি প্রার্থী আছেন, যারা মনোনয়ন চান। কিন্তু এই মনোনয়নপ্রত্যাশীরা রাজনৈতিকভাবে কতটা যোগ্য তা কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না। সারাজীবন ব্যবসা-বাণিজ্য করে হঠাৎ দেখা গেল রাজনীতির খায়েশ হয়েছে, টাকার জোরে মনোনয়ন কিনে প্রার্থী হয়ে গেলেন। ব্যস, জিতেও হয়তো গেলেন ওই একই কারণে। এলাকাবাসী এমপি পেল, নেতাও পেল। কিন্তু বাস্তবিক তিনি কতটা নেতার যোগ্য সে হিসাব কেউ করছে না। ফলে নেতার সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু মান বাড়ছে না। অনিবার্য ফলস্বরূপ রাজনীতিও প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দিচ্ছে আমজনতার কাছে। তারা এখন আর রাজনীতির প্রতি আগ্রহী নয়। বরং সমাজ জীবনে এই ঝামেলাটা না থাকলেই যেন তারা খুশি। অথচ রাজনীতিই এক সময় এ দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে, দেখিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার পথ। আজ চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
রাজনীতিতে যে অবক্ষয়ের ধারা বর্তমানে চলছে, তা থেকে ছাত্র রাজনীতিও রেহাই পাচ্ছে না। দলগুলোর ছাত্রফ্রন্টের নেতৃত্বে রয়েছে অছাত্ররা। আর এ অছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে ছাত্র সংসদের অনুপস্থিতি। যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো, তখন শিক্ষিত এবং ছাত্ররাই সংগঠনগুলোয় নেতৃত্ব দিত। একটি এলাকার কলেজের নির্বাচিত ভিপি-জিএস বা ওইসব পদে প্রতিদ্বন্দ্বীকারীরাই হতো এলাকার শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতা। সে সময় অছাত্রদের ছাত্র সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল না। আর এখন? পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। প্রকৃত ছাত্রদেরই জায়গা নেই ছাত্র সংগঠনে। অছাত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত, ঠিকাদার- এরা এখন ছাত্রনেতা। কেউ কেউ বিবাহিত এবং সন্তানের জনক। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। বছর সাতেক আগের কথা। আমার এলাকার এক ছেলে এসে বলল, 'চাচা, আমি তো ছাত্র রাজনীতি করি। তো এবার উপজেলা কমিটিতে একটি পদ পেতে চাই। আপনি একটু বলে দিন।' আমি তাকে প্রশ্ন করলাম- তুমি কী করো? বলল, একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছি। জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে করেছ? লজ্জিত হয়ে ছেলেটি বলল- কী বলেন চাচা? লেখাপড়াই তো শেষ হয়নি। তাকে বললাম, তুমি কোনো পদ পাবে না। কেন চাচা? ছেলেটির বিস্ময়মাখা প্রশ্ন। বললাম, পদ পেতে হলে তোমাকে প্রথমে অছাত্র হতে হবে। তারপর বিবাহিত হতে হবে। সন্তান থাকলে তা হবে বাড়তি প্লাস পয়েন্ট। যেহেতু তুমি ছাত্র এবং অবিবাহিত, তাই তুমি অযোগ্য। আমার কথায় মন খারাপ করা ছেলেটিকে ভালোভাবে পড়াশোনা করে নিজের জীবনকে গড়ে তোলার পরামর্শ দিলাম। তবে গোপনে ওর জন্য তদবির করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম ওকে কোনো পদ দেওয়া হয়নি। ওর কাঙ্ক্ষিত পদটি যাকে দেওয়া হয়েছে তার ক্লাস সিক্স পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার রেকর্ড আছে।
না, এটা বলছি না যে, তাই বলে মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতিতে আসছে না বা এখনও একেবারে নেই। কিছু মেধাবী ছেলেমেয়ে এখনও ছাত্র রাজনীতিতে আছে। তবে তারা মেইন স্ট্রিমে আসতে পারে না। অর্থবল আর বাহুবলে যারা এগিয়ে তাদেরই পছন্দ মূল রাজনৈতিক নেতৃত্বের। ফলে মেধাবী নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কাঙ্ক্ষিত প্রক্রিয়া এক রকম মুখ থুবড়েই পড়ে আছে।
কিছুদিন আগে ডাকসুসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের একটি দাবি উঠেছিল। একজন প্রতিবাদী অনশনও করেছিলেন। আদালত থেকেও ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আর কোনো সাড়া-শব্দ নই। কেন নেই? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর কারও কাছে আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের না হয় ছাত্র সংসদ না হলেও চলে। কিন্তু বিরোধী দলগুলো কেন এ দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে না? তারাও কি চায় না শিক্ষিত নেতৃত্ব গড়ে উঠুক?
লেখক: সাংবাদিক
সৌজন্যে: সমকাল