ছাত্রকল্যাণের টাকা ‘ইচ্ছেমতো’ খরচ করেন ভিসি নাসির - দৈনিকশিক্ষা

ছাত্রকল্যাণের টাকা ‘ইচ্ছেমতো’ খরচ করেন ভিসি নাসির

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য গড়া দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকা এমন সব খাতে খরচ করা হচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরাও।

শিক্ষার্থীদের সহায়তার বাইরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মারামারির আপ্যায়ন, মারামারির পর ভাঙচুর হওয়া মোটরসাইকেল মেরামত, মামলা পরিচালনাসহ অনেক খাতে খরচ হয়েছে এই অর্থ। শুধু তাই নয়, দুর্যোগ আর ছাত্র-কল্যাণ তহবিলের টাকা দেয়া হয়েছে দুইজন শিক্ষককেও। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মাসুম বিল্লাহ ও নাদিম মাহমুদ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীদের অর্থেই এই তহবিল গড়ে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এজন্য প্রতি সেমিস্টারে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে নেয়া হয়।

অভিযোগ উঠেছে, কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামতো তহবিলের টাকা ব্যয় করেন উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। দুর্নীতির অভিযুক্ত এই শিক্ষক বিরোধী মতকে দমনের জন্যও এই টাকা খরচ করেন বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভাষ্য।

ভিসিবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পদত্যাগী সহকারী প্রক্টর হুমায়ুন কবির বলেন, “ফান্ডটা ভালো, কিন্তু যে পন্থায় টাকা খরচ হয় সেটা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। উপাচার্য নিজের ইচ্ছায় ফান্ডের টাকা খরচ করেন।

“দায়িত্বে থাকার সময় কাছ থেকে দেখেছি, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, তাকে এই ছাত্রকল্যাণ তহবিলের টাকা দিয়ে দেয়া হয়। চিকিৎসা ব্যয়ের নাম করে এমন ছাত্রকে টাকা দেয়া হয়েছে, যার চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনি।”

উপাচার্যের আচরণের কারণে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার ‘সাহস’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পান না মন্তব্য করে হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।
গত বছরের ১২ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে ৩৬৫ জনকে নামে-বেনামে ৭১ লাখ ৯০ হাজার ২৭৮ টাকা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই তহবিলে খরচের হিসাবের একটি অনুলিপি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে, যাতে উপাচার্য নাসিরউদ্দিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ছাত্র-কল্যাণ তহবিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক আশিকুজ্জামান ভুঁইয়ার স্বাক্ষর রয়েছে।

এর মধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে উপাচার্য নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকায় অনিয়ম প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কথা বলতে রাজি হননি উপাচার্য নাসিরউদ্দিন। গ্রামবাসীর সঙ্গে মারামারির আপ্যায়ন বাবদ খরচের বিষয় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এগুলো ভুয়া কথা।”

এরপর অধ্যাপক নাসির বলেন, “আপনি একটি চিঠি পাঠান। চিঠি পাঠালে জবাব পাবেন।”

প্রক্টর ও ছাত্র-কল্যাণ তহবিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, “আমরা প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা প্রতি সেমিস্টারে জমা রাখি। সেই টাকা থেকে দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলে ব্যয় করা হয়। আমরা ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে লাইব্রেরির ডিউটির নাম দিয়ে ৩ হাজার টাকা করে দিই।”

গ্রামবাসীদের সঙ্গে মারামারির আপ্যায়ন!

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খরচের তালিকা বিশ্লেষণে এমন অনেক খাতে খরচ দেখানো হয়, সেসব এই তহবিলের টাকা খরচ হওয়ার কথা নয় বলে কয়েকজন শিক্ষকের ভাষ্য।

খরচের বড় খাতের মধ্যে চিকিৎসা সাহায্য, লাইব্রেরি ডিউটি, ঈদে ছাত্র-ছাত্রীদের খাবার পরিবেশন, র‌্যাগ ডে প্রভৃতি রয়েছে। এর বাইরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মারামারির আপ্যায়ন, মারামারির ঘটনায় নষ্ট মোটরসাইকেল মেরামত ও মামলার খরচ দিতে দেখা যায়।

খরচের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ অগাস্ট ‘গ্রামবাসীদের সাথে মারামারির সময় ছাত্রদের আপ্যায়ন বাবদ’ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এ বছরের ২৮ মে ‘গ্রামবাসীদের সঙ্গে মারামারির কারণে মোটরসাইলে ক্ষতির জন্য আর্থিক সাহায্য’ নামে দেয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৩৬৫ টাকা।

গ্রামবাসীদের সঙ্গে যে মারামারি হয়েছে, তার মামলা পরিচালনার জন্য কাজী মেজবা উদ্দীন নামের একজনকে দুই দফায় ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়।

মামলা ও মটরসাইকেল মেরামতের জন্য খরচ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রক্টর আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা স্থানীয়দের সাথে মারামারি করেছিল, ওই মামলার জন্য তাদের সহায়তা দেয়া হয়।

চিকিৎসা খরচের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন

দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলের বড় অর্থ খরচ হয়েছে চিকিৎসা ও লাইব্রেরি ডিউটি খাতে। তবে কয়েকজনের চিকিৎসা খরচ ও চিকিৎসা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন শিক্ষার্থী গত বছরের ১৭ জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সাত দফায় একই চিকিৎসায় এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন। ফেস্টুলা চিকিৎসায় ভারতে যাওয়ার জন্য গত ১৪ মার্চ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম সাকিব, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত।

ব্যবস্থপনা বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, “পঞ্চম শ্রেণিতে থাকার সময় আমার ফেস্টুলা ধরা পড়েছিল। এরপর আমি অষ্টম শ্রেণিতে অস্ত্রোপচার করে ভালো হয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর  গত বছর ভারতের বিকে বালা হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছিলাম।”

ময়নমনসিংহের এই শিক্ষার্থী বলেন, “এই বছর ভিসি স্যার আমাকে বলেছিল, চিকিৎসার জন্য টাকা নিলে চিকিৎসার ভাউচার জমা দিতে। আমি ১ লাখ ৯০ হাজার টাকার তুলেছি।”

ময়মনসিংহ বিভাগীয় ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান সোহাগের নামে গত ২১ মে ২৫ হাজার এবং ২৭ মে আরিফুল ইসলামকে আরও ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। তবে খাতের জায়গায় লেখা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ।

রাশেদুজ্জামানকে এই টাকা দেয়ার বিষয়ে প্রক্টর বলেন, “তাকে মাদক নির্মূলে অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য দেয়া হয়েছিল।”

লাইব্রেরিতে কাজের বিনিময়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে। তবে কী কাজের জন্য সে টাকা দেয়া হয়, তা স্পষ্ট নয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক অধ্যাপক বি কে বালার কাছেও।

জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “কাগজে-কলমে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত লাইব্রেরির দেখভালের জন্য কিছু ছেলেকে দায়িত্ব দেয়। কিন্তু আমার লাইব্রেরিতে কর্মচারী থাকায় তাদের দ্বারা দৃশ্যত কোনো কাজ করানো হয় না। এটা মূলত এক ধরনের আর্থিক সহায়তা। তবে ভিসি স্যার মাঝে মধ্যে এদের দ্বারা বৃক্ষরোপণ ও অন্যান্য কাজ করে নেন।”

লাইব্রেরির ডিউটির নামে অন্তত ১৫ বারে ৭২ হাজার টাকা পেয়েছেন মাকের্টিং বিভাগের আবুল হাসান এবং ১৪ বারে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সেলিম আহমেদ।

দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের এইভাবে আর্থিক সহায়তা না দিয়ে বৃত্তি হিসেবে কেন দেয়া হয় না, এমন প্রশ্নে ময়মনসিংহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অধ্যাপক বি কে বালা বলেন, “আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের বৃত্তি হিসেবে দেয়া হয়, তবে এখানে কেন এইভাবে দেয়া হয় তা উপাচার্য ভালো বলতে পারবেন।”

টাকা গেছে ‘শিক্ষকদের নামেও’

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টাকায় শিক্ষার্থীদের জন্য গড়া এই তহবিল হলেও এই খাত থেকে রবিউল্লাহ্ নামের এক শিক্ষক ৩০ হাজার টাকা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সেমিনারের জন্য নিয়েছেন। বিভাগের উন্নয়ন তহবিল থাকার পরও দরিদ্র তহবিল থেকে কেন অর্থ সহায়তা দেয়া হল, তার ব্যাখ্যা দেয়নি প্রশাসন।

একইভাবে পর্যটন ও আতিথেয়তা বিভাগের শিক্ষক মোকলেছুর রহমান বিভাগের কাউন্সিলিংয়ের জন্য এই তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর।

র‌্যাগ ডেতে টি শার্ট তৈরির জন্য তামান্না এন্টারপ্রাইজকে গত বছরের ১৮ অক্টোবর ৪৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর তিন দিন আগে র‌্যাগ উপলক্ষে রাকিবুল ইসলাম নামে একজনকে দেয়া হয় ৩৫ হাজার টাকা।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২৭ জন নেপালি ছাত্র ও ১৭ জন ছাত্রী পড়াশোনা করে। এছাড়াও ৩-৪ জন সোমালিয়ান পড়াশুনা করে। প্রতি ঈদে এদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।

সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ‘বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাপায়ন’ বাবদ দুই লাখ টাকা ছাত্র-কল্যাণ তহবিল থেকে ইমরুল বিশ্বাস নামে একজনকে দেয়া হয়।

ঈদে এই সব বিদেশি শিক্ষার্থীদের কীভাবে অ্যাপায়ন করা হয়, তা প্রতিবেদকরা জানতে চেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির ভেটেনারি মেডিসিনের নেপালি শিক্ষার্থী গোপাল ঝাঁর কাছে।

বাংলা বলতে পারা এই শিক্ষার্থী বলেন, “ঈদে আমাদের জন্য বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান থাকে না। যেসব স্টাফ এখানে থাকে তাদের সাথে আমাদের একটা বিরিয়ানির প্যাকেট দেয়া হয়েছিল। এর বাহিরে আমাদের কোনো অনুষ্ঠান হয় না। সেটাও এক বেলা ছিল।”

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075669288635254