ছাত্ররাজনীতির সর্বশেষ শিকার হলেন বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। যিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রবিবার রাতে বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলের একটি কক্ষে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ সিঁড়িতে ফেলে রাখে। এই ঘটনা সংঘটনের ঠিক ১৭ বছর আগে বুয়েট ক্যাম্পাস রক্তাক্ত হয় সাবেকুন নাহার সনির রক্তে। টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের বিবদমান দুটি গ্রুপের গোলাগুলিতে প্রাণ হারান বুয়েটের ঐ মেধাবী ছাত্রী। শুধু মেধাবী শিক্ষার্থীরাই নন, ছাত্ররাজনীতির নির্মম বলি হন পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিত্ দাসসহ আরো অনেকেই। একটি ঘটনা স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার আগেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর অভিমত দিয়েছে হাইকোর্ট। বুধবার (৯ অক্টোবর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন দিদারুল আলম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বজিতৎ দাস হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছে, দেশের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘ সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস কিছু তরুণের জন্য কলঙ্কিত হচ্ছে। এরা ছাত্ররাজনীতির নামে প্রকৃতপক্ষে সংঘবদ্ধ অপরাধে সম্পৃক্ত। এ পরিস্থিতি উদ্বেগ ও হতাশার। জাতি এ থেকে পরিত্রাণ চায়। এটি আশা করা যায় যে সরকার ও বিরোধীপক্ষের দায়িত্বশীল জাতীয় নেতারা এই সমস্যার সমাধানে ছাত্ররাজনীতি ও আন্দোলন বিষয়ে নীতি গ্রহণ করবেন।
কিন্তু হাইকোর্টের এই অভিমত আমলে নেয়া হয়নি। ছাত্ররাজনীতি ও আন্দোলন নিয়ে প্রণীত হয়নি কোনো নীতি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ আদালতের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অভিমত আমলে নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন করা গেলে হয়তো ছাত্রসংগঠনগুলোকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব হতো।
গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, আবরার হত্যাকাণ্ড খুবই দুঃখজনক। কেউ ভিন্নমতাবলম্বী হলেও তাকে মেরে ফেলা যায় না। ছাত্রলীগ অনেক ভালো কাজও করেছে। চাঁদের গায়েও খুঁত আছে। তবে গুটিকয়েক লোকের কারণে আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না।
জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ডাকসুর সাবেক জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। দেশে এখন সুস্থ রাজনীতির প্রচণ্ড অভাব। আমি মনে করি, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সব দল মিলে একটি জাতীয় ঐকমত্যে আসা উচিত। যাতে দেশে ছাত্ররাজনীতির সুস্থ বিকাশ আমরা ঘটাতে পারি। ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির বিকাশকে যেন আবার পুনরুদ্ধার করতে পারি।’
হাইকোর্টের রায়ে আরো বলা হয়েছে, এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য কিছু তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা নিজেদের স্বার্থে ছাত্রনেতাদের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন। পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ এবং বিশৃঙ্খল হলেও রাজনীতিবিদরা তরুণ এবং শিক্ষার্থীদের আইন নিজের হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষের কর্মীদের প্রতিরোধে উৎসাহ দেয়া উচিত নয়। কেননা এসব সংঘাতপূর্ণ ও বেআইনি কর্মকাণ্ড দেখার জন্য পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, কিছু কিছু ছাত্র ও ছাত্রনেতার কর্তৃত্ব, উচ্ছৃঙ্খলা ও অপরাধপ্রবণতার মূলোৎপাটন করতে হলে প্রথমেই ভাইস-চ্যান্সেলরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণের মনোভাব পরিহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ভিসি, প্রক্টর, প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এদের কর্তৃত্ব যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ হতো, তাহলে কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষেই উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রশাসন রয়েছে তাদের ব্যর্থতার কারণেই হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। যেখানে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার ইন্ধন রয়েছে।