ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কি - দৈনিকশিক্ষা

ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা আছে কি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বারাক ওবামা আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে পড়েছেন। তিনি কি ছাত্ররাজনীতি করে এত বড় নেতা হয়েছেন? জার্মানির চ‍্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ৩১ বছর বয়সে কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেছেন। রাজনীতি শেখার জন্য তিনি কোথায় ছাত্ররাজনীতি করেছেন? পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কি ছাত্ররাজনীতি করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন? দুনিয়ার বহু বাঘা বাঘা নেতা, যাঁরা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের রাজনীতি শিখতে ছাত্ররাজনীতি করতে হয়নি। রাজনীতি শেখার জন্য কি শুধু বাংলাদেশের নেতাদেরই ছাত্ররাজনীতি করতে হয়? মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, রাজনীতি করতে হলে দরকার হয় তিনটি জিনিস। সততা, কমিটমেন্ট ও সত্য উচ্চারণের সাহস। আর সঙ্গে মেধা যুক্ত হলে সোনায় সোহাগা। ছাত্ররা তাদের বয়সে পড়বে। জ্ঞানার্জন করবে। কারণ, এটার একটা সময় থাকে। ৪০ বছরে নেতা হওয়া যায়। ৪০ বছরে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ব‍্যাচেলর করা যায়? ‘ছাত্রনং অধ‍্যয়নং তপঃ’-এর বাইরে তো কোনো কথা নেই।

তবে সমাজের উন্নয়ন, মানুষের কল্যাণ, ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিদ‍্যাপীঠের উত্তরোত্তর মান বৃদ্ধিতে সংগঠন করা, সভা-সমিতি করা, প্রতিবাদ করা কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে তর্কবিতর্কের চর্চা করা অবশ্যই দরকার। এগুলোই হলো সত‍্যিকারের ছাত্ররাজনীতির চর্চা।

কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে যে দলীয় ও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি, সেটার প্রয়োজনীয়তা কী? সেটা কি আদৌ ছাত্ররাজনীতি, নাকি নৈরাজ্য ও নোংরামি?

নেতার মাথায় ছাতা ধরার জন্য ধাক্কাধাক্কির নাম ছাত্ররাজনীতি নয়। নেতার সঙ্গে ছবি তুলে পূজা করার নাম ছাত্ররাজনীতি নয়। নেতার কথায় সকাল–সন্ধ্যা ওঠবস করা, নেতার সঙ্গে হুজুর হুজুর করার নাম রাজনীতি নয়। এটার নাম হলো পুচ্ছ লেহন।

নেতার আনুগত্যের জন্য যখন-তখন কাউকে মারা, ধরে আনা ইত‍্যাদির অপকর্মের নাম রাজনীতি নয়। নেতার অপকর্মকে সমর্থন করার নাম ছাত্ররাজনীতি নয়। বাসে, ট্রেনে গায়ের জোরে সিট দখল করে রাখা, টাকা না দিয়ে খাওয়া, বড় ভাইয়ের ক্ষমতায় নিজের ভেতর সাহস বোধ করার নাম ছাত্ররাজনীতি নয়। একটা পদের লোভে দিনরাত নেতার ছায়া হয়ে থাকার নাম ছাত্ররাজনীতি নয়।

এই রাজনীতির চর্চা করে রাজনীতিক হয় না, হয় পাষণ্ড। হয় বর্বর। নেতা হওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতি করতে হয়। এর চেয়ে খোঁড়া যুক্তি সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরও দুঃখের বিষয় হলো আমাদের চলমান ছাত্ররাজনীতিতে এই অনাচারের চর্চাগুলোই হয়! এই চর্চা করে ছাত্রত্ব পার করা ছাত্ররা শিক্ষক হচ্ছে। অফিসার হচ্ছে। প্রশাসনিক ক‍্যাডার হচ্ছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির কুফলে শুধু বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোতে অসংখ্য শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে বর্বরতম, পৈশাচিক যে হত‍্যাকাণ্ড হয়েছিল, সেটার মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল হত্যার ছাত্ররাজনীতি। ‘সেভেন মার্ডার’ নামে পরিচিত সে খুন ইতিহাসে আজও আলোচিত ও ঘৃণিত।

গত ১০ বছরেই প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এমন নৈরাজ্যের কারণে বছরের পর বছর লেগেছিল সেশনজট এবং শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে ঝরেছে সময়।

ছাত্ররাজনীতির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে অসংখ্য নিরপরাধ শিক্ষার্থী ছাত্রজীবন শেষ না করে ক‍্যাম্পাস ছেড়েছেন। অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সহস্র ছাত্র কারাগারে কাটিয়েছেন, বহিষ্কৃত হয়েছেন। শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেননি। ছাত্ররাজনীতির প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন অনেক অযোগ্য শিক্ষক।

প্রতিটি সরকার তাদের পছন্দমতো প্রার্থীদের বেছে নিয়েছে নিজেদের ছাত্রসংগঠনের নেতা থেকে। নিয়োগপ্রাপ্ত সেই শিক্ষকেরা জোট হয়ে ক‍্যাম্পাসে রাজনীতি করেছেন। তাঁদের রেষারেষি, মতাদর্শের দ্বন্দ্ব, এমনকি ব‍্যক্তিগত হিংসা-প্রতিহিংসার কারণে বিভিন্নভাবে ব‍্যাহত হয়েছে শিক্ষার্থীদের ছাত্রজীবন।

ছাত্ররাজনীতির নেতা-কর্মী দিয়ে প্রতিটি সরকার তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তরুণদের মুখ রুখে দিয়েছে। তরুণেরা যখনই কোনো সরকারের সাম্প্রদায়িকতা, ব‍্যাংক লুট, রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী চুক্তি কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিকিয়ে দেওয়ার মতো কাজে লিপ্ত ছিল, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারেননি। শিক্ষকেরা কথা বলতে পারেননি।

কোনো ছাত্রসংগঠনই নিজ দলীয় সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো দিন প্রতিবাদ করেনি। ছাত্ররাজনীতির প্রশ্রয় পেয়ে বহু অছাত্র, ছেঁচড়া, চোর-বাটপার, মূর্খ, মাদকসেবী ক‍্যাম্পাসে বিচরণ করেছে। ক‍্যাম্পাসের পরিবেশ নানাভাবে কলুষিত করেছে। ছাত্ররাজনীতির কারণে ছাত্রাবাসগুলোতে টর্চার সেল তৈরি হয়েছে। র‍্যাগ ও অন‍্য মানসিক নির্যাতন প্রতিনিয়ত হচ্ছে।

শিক্ষকদের সামনে নৈতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন করার নাম ছাত্ররাজনীতি। শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না কেন? পরীক্ষা দেরি করে হচ্ছে কেন? রেজাল্ট দেরি করে দেবে কেন? এগুলোর জন্য প্রতিবাদ করার নাম ছাত্ররাজনীতি।

একজন অযোগ্য উপাচার্যকে নামিয়ে সবচেয়ে মেধাবী, সৎ ও যোগ্য শিক্ষককে উপাচার্য করার জন্য যূথবদ্ধ হওয়ার নাম ছাত্ররাজনীতি।

জাতীয় নেতাদের ক‍্যাম্পাসে ডেকে এনে তাঁদের কৃতকর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করার নাম ছাত্ররাজনীতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান-গবেষণার জন্য বাজেট বৃদ্ধির দাবিতে কণ্ঠ তোলার নাম ছাত্ররাজনীতি। শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করার জন্য আন্দোলন করার নাম ছাত্ররাজনীতি। একজন শিক্ষক নিয়োগেও যদি অনিয়ম হয়, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নাম ছাত্ররাজনীতি। বছর বছর গবেষণায় মান বৃদ্ধি না পেলে সেগুলো নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্তাদের চাপ দেওয়ার নাম ছাত্ররাজনীতি।

দেশের সরকারের যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নাম ছাত্ররাজনীতি। শিক্ষার্থীদের আবাসন, যাতায়াত ও জ্ঞান-গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য আর্থিক ও অন‍্য সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে কথা বলার নাম ছাত্ররাজনীতি।

লেজুড়বৃত্তিক, দলীয় ও সরকারের অধীন ছাত্রসংগঠন ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য এ দেশে আর কত বর্বরতা, আর কত নৃশংসতা, আর কত অন্ধকার যুগের ভয়াবহতার প্রয়োজন জানি না।

আমাদের শিক্ষা যে পৃথিবীর আলোকে এখনো কত পিছিয়ে আছে, সেই উপলব্ধি আমরা কবে করব? আর এই পিছিয়ে পড়ার জন্য নামধারী এমন নৈরাজ্য ও পেশিশক্তির ছাত্ররাজনীতি বহুলাংশে দায়ী। আমাদের চলমান ছাত্ররাজনীতি থেকে সুফল আসবে, এমন বিশ্বাসে যারা এটিকে টিকিয়ে রাখার সমর্থন করেন, তারা হয় অজ্ঞ, নয় অসচেতন বা সুবিধাভোগী।

ড. রউফুল আলম : গবেষক।

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037240982055664