জঙ্গিবাদের ব্যাপ্তি ও শিক্ষার দৈন্য - Dainikshiksha

জঙ্গিবাদের ব্যাপ্তি ও শিক্ষার দৈন্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পশ্চিমা ধারায় শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে বা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। এর মূল কারণ পশ্চিমা ধারার শিক্ষা মানুষের মধ্যে কোনো সামাজিক দায়িত্ববোধ সৃষ্টিতে অক্ষম। চর্বিত চর্বণ গবেষণা ও দাম্ভিক শ্রেষ্ঠত্বের বিস্তারের প্রভাবে এরা সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন এক শ্রেণিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। আবার তাদের মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে দরিদ্র ও দারিদ্র্যের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে ঘৃণা। এমনকি অতি নির্মমভাবে আধুনিক শিক্ষা তাদের ক্রমে ক্রমে ভিন্ন জগতে বিচরণের স্পৃহায় আবিষ্ট করছে। সোমবার (১৫ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকার এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন নাসির উদ্দিন আহমদ নোমান।

অন্যদিকে দরিদ্র বা নিম্নবিত্তের পরিবারগুলোকে খুব সহজে প্রভাবিত করছে অসুস্থ ধর্মতাত্ত্বিক বা পুঁজিপতিরা। মনে রাখতে হবে, বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা ও তার পূর্ব-পশ্চিমের মিত্ররা। এরাই পুঁজি ঢালছে বা আরব দেশগুলোকে পুঁজি ঢালতে প্রভাবিত করছে সন্ত্রাসবাদের বিস্তৃতিতে। এদের এ পুঁজিপ্রবাহ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে বা এনজিওর মাধ্যমে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে। এটা সহজেই অনুমেয় যে দারিদ্র্যকবলিত এই শ্রেণির সন্তানদের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদি সবাইকে একই ধারায় শৃঙ্খলাবদ্ধ করে বাধ্য করছে জিঘাংসু প্রকৃতির মানবে রূপান্তরে। অত্যাচার-নিপীড়নের ভয় বা দারিদ্র্যের ভয়ের বিপরীতের বিচিত্র সব পুরস্কারের লালসায় আবিষ্ট করে এদের সামাজিকতাবর্জিত বিচ্ছিন্ন মানবে পরিণত করে এদের দিয়েই ঘটানো হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক বিস্তার।

আধুনিক পশ্চিমা ধারার শিক্ষায় মানবিকতার বিকাশ বা সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো একেবারেই অবহেলিত। আবার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অনৈতিক পিপাসা পূরণে মগ্ন শিক্ষিতরাই শিল্পপতি, পুঁজিপতি, ভূস্বামী, শিক্ষক, আমলা, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি। এদের প্রায় সবাই ব্যস্ত পিরামিডের চূড়ায় আরোহণে। আর তাদের দেখে দেখে প্রভাবিত শিক্ষিত তরুণরা সিসিপাসের মতো পিরামিডের চূড়ায় যাত্রার ঘর্মক্লান্ত ব্যর্থ কর্মে জীবন করছে শেষ। একদিকে শিক্ষার ফলে পুরস্কারের ঝোলানো মুলা, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত হয়েও সামান্য কিছু অর্জনে ব্যর্থতা বিশাল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করছে। এই চলমান পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী যারা, তাদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ লুণ্ঠিত হয়ে খুদকুঁড়া কুড়াচ্ছে, কেউ কেউ ভাগ্যদেবতার দুর্ভাগ্যের কাছে সমর্পণ করছে নিজেকে; কিন্তু কেউ কেউ প্রতারিত হয়ে জীবনমুক্তির বিভোর স্বপ্নে বিপথে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমরা পশ্চিমা শিক্ষাকে উন্নয়ন ও আধুনিকতার বাহন হিসেবে শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুকরণ করেছি। এই শিক্ষা একদিকে আমাদের করেছে পশ্চিমানির্ভর, অন্যদিকে করেছে আত্মিকভাবে শূন্য। কারণ এই শিক্ষা আত্মশুদ্ধি বা মানবতাবাদের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে অক্ষম। এই দৈন্যটুকুর প্রভাবেই শোষণ-বঞ্চনার বিস্তৃতি ঘটেছে দেশে দেশে। জমে উঠছে শ্রেণিতে শ্রেণিতে ক্ষোভের পাহাড়। সহজেই তা রূপ নিচ্ছে রক্তক্ষয়ী। সমস্যা সৃষ্টি করে তা নিরাময়ের যে পথ দেখিয়েছে পশ্চিম শিক্ষা, তা আরো ভয়াবহ। নিপীড়ন, নির্যাতন ও শক্তির ব্যবহারই এ ক্ষেত্রে মুখ্য। শক্তির প্রয়োগ প্রত্যেককে শক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করে। ফলে বিশাল সামরিক শক্তিকে প্রত্যক্ষ মোকাবেলা না করতে পারলেও বিক্ষিপ্তভাবে সন্ত্রাসবাদই হয়ে ওঠে বঞ্চিতদের নির্ভরতার হাতিয়ার। আবার পশ্চিমাদের বিকল্প শিক্ষা হিসেবে অন্য পক্ষ ধর্মীয় ধারার ব্যাপ্তিকে করে নিয়েছে বিকাশ ও উন্নতির হাতিয়ার। এই শিক্ষা পরকালের গুরুত্বনির্ভর। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুস্পষ্ট পরিকল্পনাহীন এই শিক্ষা আত্মিক শুদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হলেও বৈষয়িক জীবন ব্যবস্থার দিকনির্দেশনার অনুপস্থিতি রয়েছে এর মূলে। ফলে বিরাজ করছে এক বিশাল শূন্যতা, এটা পার্থিব ব্যবস্থায় পশ্চিমা উন্নয়নের সমান্তরালে দাঁড়াতে অক্ষম।

আবার রয়েছে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষা। প্রথমেই শিশু শিক্ষার্থীকে এই ধারা সমাজের সব থেকে আলাদা করে ফেলে দেয় এক আত্মপরিচয়ের সংকটে। তারপর তা অতিমাত্রায় পশ্চিমা; যত বেশি পশ্চিমা তত বেশি বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব; তত বেশি বৈষয়িক উন্নতির ভাবধারা ও শোষণপ্রবণতার বিস্তৃতি। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই। বিচ্ছিন্নতাবোধ ও স্বার্থপরতার বিস্তৃতি সৃষ্টি করে বিপন্ন মানবসত্তা। পশ্চিমানির্ভর অন্যদের মতো এদেরও চূড়ান্ত ফলাফল সামাজিক দেউলিয়াপনা। ঔপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে এক শৃঙ্খলে।

ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষার বিকাশের ভিত্তিপ্রস্তুর  ইংরেজদের হাতে এবং রাষ্ট্রের কাঠামো ঔপনিবেশিক ভাবধারায় সজ্জিত। ম্যাকুলের সেই কেরানি সৃষ্টির লক্ষ্যে বিকশিত শিক্ষা আজও চলছে স্বাধীন বাংলাদেশে। শিক্ষিতরা তাই মানসিকভাবে পরনির্ভর। পরনির্ভরতাই শিক্ষিতদের সার্থকতার সোপান, আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন এখনো দূরাহত। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর, সব দৈন্যের উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন গড়তে হবে। দেশীয় সমাজ বাস্তবতাকে ভিত্তি করে রচিত হতে হবে শিক্ষার উপকরণ। বৈশ্বিক, বৈষয়িক ও আত্মিক উন্নয়নের সমন্বয় ঘটাতে হবে স্বকীয় ভাবধারা সৃষ্টির মাধ্যমে।

বিদেশিদের দেওয়া নতুন নতুন প্রকল্প কল্পলোকের গল্পের মতোই স্বপ্নময়তায় বিচরণের পথ দেখাবে তরুণদের। ওই সব অর্থব্যয়ে কেনা অর্থহীন প্রকল্প ও মূল্যায়ননির্ভরতা বাদ দিয়ে আমাদের সমাজের প্রয়োজনে অর্জিত জ্ঞান ও বিশ্বমানবের জ্ঞানভাণ্ডারের যৌক্তিক সম্মিলন ঘটিয়ে সাজাতে হবে আগামী প্রজন্মের শিক্ষাব্যবস্থা—তবেই আমরা জঙ্গিবাদ ও কর্মবিমুখতার দুষ্ট ছোবলমুক্ত প্রজন্মের অভিভাবকত্বে অলংকৃত হব।

লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, কলা অনুষদ, লিডিং ইউনিভার্সিটি

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041961669921875