জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি : মজলিশি মুজতবা আলী - দৈনিকশিক্ষা

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি : মজলিশি মুজতবা আলী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমার ছোট চাচা সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের দাদা তখন সেখানে কর্মরত ছিলেন। চাচা তার অনবদ্য সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন তার পাঠকদের কাছে। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

অমর কথাশিল্পী, ভাষাবিদ ও বাংলা সাহিত্যের অমর পুরুষকে আমরা স্মরণ করব এই দিনে তার কীর্তির জন্য। বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনা ও ভ্রমণ কাহিনী তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তার লেখা প্রায় পঁয়ত্রিশটি বই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের এবং তা সমানভাবে সমাদৃত।

সব মানুষেরই নানা পরিচয় থাকে নানাজনের কাছে, তা বিভিন্নভাবে উঠে আসে। আমার কাছে আমার মহাপণ্ডিত চাচা একজন মজলিশি মানুষ, যিনি কথার জাদুকর এবং তার গুণগ্রাহী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন অকাতরে।

শেখাতেন অনেক বাখানিয়া করে ও উদাহরণ দিয়ে। শেখানোর পদ্ধতিটা সরাসরি নয়; কিছুটা ভাষায়, কিছুটা বর্ণনায় তা তুলে ধরতেন। বাকিটা শ্রোতা সামর্থ্য অনুযায়ী বুঝে নিত। কাজেই তার আড্ডায় যোগ দেয়া ছিল সহজ। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া না করলে তার কথার মারপ্যাঁচ বোঝা হতো কঠিন।

যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে চাচা ঢাকায় এলেন বেড়াতে। উঠলেন মেজো চাচার বাসায়, ধানমণ্ডির সাত নম্বর রাস্তায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল আড্ডা। প্রথম পর্বে চাচা ও তার ভাইবোনদের মধ্যে আড্ডা। পাকিস্তানের রাজনীতি তখন উত্তপ্ত। আইয়ুব খান সামরিক শাসনকে গণতন্ত্রায়ন করতে চাচ্ছেন, ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’র মাধ্যমে।

ফলস্বরূপ রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হতে যাচ্ছে দু’মাস পর। আইয়ুবের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রার্থী দিয়েছে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কনিষ্ঠ ভগ্নী ফাতেমা জিন্নাহকে। সরকারি মোল্লারা ফতোয়া দিলেন রাষ্ট্রপরিচালনায় নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। ছোট ফুপু তার আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বিদ্বান ভাইকে পেয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, এ ব্যাপারে ইসলামী বিধান কী?

চাচা কখনও সরাসরি উত্তর দিতেন না। এবারও পাল্টা প্রশ্ন করলেন। মনে করো, একজন জাহাজভাঙা নাবিক সাঁতরে কোনোরকমে এক দ্বীপে উঠে আশ্রয় নিয়েছেন। কাপড়-চোপড় ঠিকমতো নেই। অজুর পানিরও বন্দোবস্ত নেই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় হয়ে গেছে। তিনি কি সেই অবস্থায় নামাজ পড়বেন? তা কি গ্রহণযোগ্য হবে? চাচাই উত্তর দিলেন, নামাজ পড়া ফরজ। কাজেই তিনি নামাজ পড়বেন।

ইসলামের প্রথম শিক্ষা ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা’। তারপর তিনি বাখানিয়া করে বোঝালেন কীভাবে যুদ্ধে বা সংকট অবস্থায় নারীরা ইসলামের ইতিহাসে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কাজেই দীর্ঘ আলোচনার পর অভিমত দিলেন, যদি অবস্থা বিবেচনায় ফাতেমা জিন্নাহকে সবাই নেতা বলে বিবেচনা করেন, তাহলে তা সিদ্ধ বা জায়েজ (পাঁচ যুগ পর এ প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশিরা একাধিকবার দিয়েছেন। আজ সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু ১৯৬৪ সালে তা ছিল একটি জ্বলন্ত বিষয়)।

২.

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে হল। লেকের পারে বাসা, মশা ছিল, এখনও আছে। চাচি আমাদের আড্ডার সুবিধার জন্য একটি ‘মশার কয়েল’ জ্বালিয়ে পাঠালেন। চাচা শুধালেন, এটা কি এ দেশেই বানাও নাকি, না আমদানি করো? চাচাকে মোরগ মার্কা বাক্স দেখিয়ে বললাম, এটা চীন থেকে আসে। তবে কুজনরা বলেন, দুই নম্বরিটা নাকি ঢাকার নদীর ওপারে জিঞ্জিরায় বানানো হয়।

চাচা জানালেন, কলকাতায়ও প্রথমে চীন থেকে আসত; কিন্তু ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর তা বন্ধ হয়ে যায়, স্বদেশেই বানায়। স্বদেশী একটা কয়েলের বাক্স তাকে কলকাতার পাড়ার দোকানদার গছিয়েছিল। পরের দিন চাচাকে দেখে জানতে চাইল, স্যার কয়েলটা কি কাজ করেছে? চাচার উত্তর- একদম, একশ’ ভাগ। দোকানদার মহাখুশি। চাচা বললেন, আসলে মশাগুলো বসার জায়গা না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কয়েলটা জ্বালানো মাত্রই বসার একটা সুন্দর জায়গা পেয়ে সবাই দলবেঁধে কয়েলের ওপর বসে গেল। আমাকে কামড়াল না। বলেই সেই বিখ্যাত অট্টহাসি।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম বলেছেন : ‘One best book is equal to one hundred friends; but one good friend is equal to a library’। আমাদের জীবনে এ বাক্যটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। চাচা মুজতবা আলীই আমাদের ‘friend, philosopher and guide’। প্রতিনিয়ত তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, জ্ঞান দিয়েছেন অতি সন্তর্পণে। যেমন- বেশি প্রশ্ন করলে কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, আমি হাওড়া রেলস্টেশনের অনুসন্ধানী বুথের কর্মচারী নই যে, তোমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আসলে চাচা প্রশ্ন করা খুব পছন্দ করতেন এবং অনেক ব্যাখ্যা দিয়ে তার উত্তর দিতেন।

যদি কোনো গুণগ্রাহী তাকে দেখে ও কথাশুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত; চাচা বলতেন, আমি আলীপুর চিড়িয়াখানার বাঘ নই যে আমাকে দেখতে হবে। বারান্তরে ছোটদের শেখাতেন কলকাতার স্টেশনটা হাওড়ায় আর চিড়িয়াখানা আলীপুরে।

হাসিঠাট্টার মধ্য দিয়ে সাহিত্য আলোচনা হতো। কলকাতার কোন্? কোন্? লেখক ভালো লিখছেন, সারা বিশ্বের মনীষীদের তত্ত্বকথা থেকে সালাদ, স্যান্ডউইচ বা ফ্রেঞ্চফ্রাই বানানো পর্যন্ত কিছুই বাকি থাকত না। এক কথায় ‘From the sublime to the ridiculous’। চাচা হরফুল মাওলানা। আমরা মূলত শ্রোতা। মাঝে মাঝে তার কথায় তাল দিচ্ছি, প্রশ্ন করছি।

একরাতে গল্প করতে করতে গভীর রাত হয়ে গেছে। পাড়ায় কর্মরত পাহারাদার মাঝে মাঝে তার ‘হুকুমদার’ হুঙ্কার দিয়ে উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে। চাচা শুধালেন, পাহারাদার কেন হুঙ্কার দেয় জানিস?

তার ‘টিকেট চেকারের কাহিনী’ স্মরণ করে বললাম, না হলে ও নিজেই তো ঘুমিয়ে পড়বে। চাচা হেসে বললেন, হুঙ্কার দিয়ে চোর-ডাকাতদের জানিয়ে দেয় ‘আমি এদিকে আছি- তোমরা যা করার অন্যদিকে করো। এদিকে এসে আমাকে বিব্রত করো না।’ সবাই চাচার সঙ্গে হাসলাম। আড্ডা সে রাতের মতো শেষ হল। চাচা ঘুমুতে গেলেন।

৩.

চাচা চিরনিদ্রায় চলে গেলেন ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সদা-সর্বত্র জেগে আছেন তার লেখার মধ্য দিয়ে। একটা আক্ষেপের কথা আগেও লিখেছি। আজও লিখছি। যে প্রতিভা, যে জ্ঞান তার ছিল, তার সিকিভাগও তিনি লিখে রেখে যাননি। ভবঘুরের মতো সারাজীবন ঘুরেছেন। কোথাও থিতু হতে পারেননি। বা চাননি। না ছিল কোনো স্থায়ী আবাস, না ছিল কোনো পড়ার ঘর, না ছিল কোনো রেফারেন্স বই। তখনও কম্পিউটার আসেনি। ফলে যা কিছু লিখেছেন, তা এসেছে তার অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি থেকে।

একদিন চাচাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘দেশে-বিদেশে’তে আপনি যেভাবে দিনক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে মনে হয় আপনি কোনো ডায়রি রাখতেন। চাচা বললেন, তিনি ‘দেশে-বিদেশে’ লিখেছেন কাবুল ছাড়ার প্রায় দুই দশক পরে।

সম্পূর্ণ তার স্মৃতিশক্তির ওপর ভিত্তি করে। কারণ তার কোনো ডায়রি ছিল না। আমাকে বললেন, ভাতিজা যখন তুমি কিছু লিখে রাখ, তখন তোমার স্মৃতিশক্তি তা ভুলে যায়, কারণ তুমি তার ওপর ভরসা করোনি। কাজেই স্মৃতিশক্তি বাড়াতে হলে ধীরে ধীরে তাকে শক্ত করো, সমৃদ্ধ করো। সে তোমার সঙ্গে থাকবে। কাগজ খুঁজতে হবে না।

চাচার স্মৃতিশক্তি বা পাণ্ডিত্যের লেশমাত্র আমাদের নেই। তবে আছে তার সঙ্গে সান্নিধ্যের মধুর স্মৃতি। মনে আছে তার পাণ্ডিত্য। সাধারণত পণ্ডিতরা কথা কম বলেন। কিন্তু আমার চাচা ব্যতিক্রম ঘটালেন। পাণ্ডিত্য ও মজলিশির সংমিশ্রণ করলেন। সেই বিরল প্রতিভার মানুষের জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী : সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039880275726318