‘জলবায়ু’ শব্দটা ব্যাপক পরিচিত হলেও অনেকেই শব্দটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেননি। বিষয়টা বোঝেন সবাই; তবে বোঝাতে সক্ষম নন। যেমনটি ‘জীববৈচিত্র্য’ শব্দের অর্থ বোঝেন; বোঝাতে পারেন না। তেমনি হচ্ছে জলবায়ু শব্দটি। জলবায়ুর ক্ষেত্রে একটা ছোট্টো হিসাব-নিকাশ আছে। হিসাবটি জানানোর আগে আমরা জেনে নেই জলবায়ুর উপাদানসমূহ। যেমন: বায়ু, বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মেঘ-বৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদি জলবায়ুর উপাদান। আর ছোট্টো হিসাবটি হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু। যার পরিবর্তনকে আমরা সাধারণত জলবায়ু সংকট বলে থাকি। শুক্রবার (২ আগস্ট) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন আলম শাইন।
জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে চলতি বছরের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। গেল বছরের তুলনায় এবারের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। যেমন: কুয়েতের তাপমাত্রা বিশ্বের ইতিহাসে চলতি বছরের তাপমাত্রা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি উঠেছে। ছায়াযুক্ত স্থানেও ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ফলে সেখানকার মানুষের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিষয়টা ভাবতেই রোম শিউরে উঠেছে আমাদের। আমরা জানতে পেরেছি সেখানকার অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে গাড়ির চাকার টায়ার পর্যন্ত গলে গেছে। শুধু কুয়েতে নয়, আমাদের দেশেও ব্যাপক তাপমাত্রা বিরাজ করছে চলতি বছরে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের শতাধিক লোকের মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছি। এসব হচ্ছে শুধু জলবায়ু সংকটের প্রভাবে। উল্লেখ্য, বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি জলবায়ুর প্রভাবেই ঘটছে। শুধু শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনার কারণেই এসব ঘটছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে। তারা একদিকে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে অনুদান দিচ্ছে। অনেকটা গোড়া কেটে জল ঢালার সামিল।
সূত্রমতে জানা যায়, হিমালয়ের বরফও গলে যাচ্ছে দ্রুততর। ২০০০ সাল পর্যন্ত হিমালয়ের বরফ শতকরা একভাগ হারে গলেছে। বর্তমানে হিমালয়ের বরফ দ্বিগুণ হারে গলছে! তাতে করে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটানসহ এশীয় অঞ্চলের শতকোটি মানুষ বিশুদ্ধ জল সমস্যায় পড়বে। উল্লেখ্য, জার্মানির বন শহরে যখন জলবায়ু সম্মেলন (২০১৯) চলছে ঠিক তখনি সায়েন্স অ্যাডভান্সেস-এ রিপোর্টে এসব প্রকাশিত হয়েছে।
আমরা জানি, সমগ্র বিশ্বে মোট মজুদ জলের পরিমাণ ১ হাজার ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। তন্মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭.২ শতাংশ। যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অপরদিকে ২.১৫ শতাংশ জল জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি .৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় .৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূগর্ভে। যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জল চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ জল হিসেবে পরিচিত। এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্যে দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে। ভূগর্ভস্থ জল ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের জল সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে গোসলাদি, রান্না-বান্না, জামা-কাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সবমিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়।
বশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এছাড়াও প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধু দূষিত জল পান করে। প্রতিদিনের জলপানের চাহিদা মেটাতে কিংবা বিশুদ্ধ জলপান থেকে বঞ্চিত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া কিংবা আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলেই বিশ্বের মোট ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় জল সংকটের মুখোমুখি হবেন। তন্মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বেন। এর থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। এছাড়াও অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশীয় অঞ্চলে এর প্রভাব পড়বে খানিকটা বেশি। তার ওপর আমাদের জন্য মহা অশনি সংকেত হচ্ছে হিমালয়ের বরফ গলার হার দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া। যেখানে ২৫ বছর আগে ৫০ সেন্টিমিটার বরফ গলেছে, সেখানে দ্বিগুণ হারে বরফ গলছে বর্তমানে।
হিমবাহ গবেষকদের অভিমত- এই হারে বরফ গলতে থাকলে এশিয়ার কয়েকটি দেশের ১০০ কোটি মানুষ সরাসরি বিশুদ্ধ জল সমস্যায় ভুগবে। এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন গবেষকরা। তারা স্পষ্ট বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামাতে হবে।
শিল্পোন্নত দেশের বলির পাঁঠা আমরা কেন হতে যাবো! কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনে আমাদেরকে বাঁচতে দিন; আমরা বাঁচতে চাই। এই গ্রহের মায়ামোহ আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এখানে আমাদের দাদা-পরদাদারা শুয়ে আছেন। আমরা যেমন কাউকে ছেড়ে গ্রহান্তরিত হতে পারব না, তেমনি আমাদের আগামী প্রজন্মকেও একটি অরক্ষিত গ্রহে রেখে যেতে পারব না। আর মানুষ যদি নাই-ই বাঁচতে পারল, চাঁদ কিংবা মঙ্গল বিজয়ে কি হবে ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা!
লেখক : কথা-সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণি বিশারদ।