জাতীয়করণের ছোট্ট একটা দাবি - দৈনিকশিক্ষা

জাতীয়করণের ছোট্ট একটা দাবি

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
দেশে বেসরকারি স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের দাবীটি এখন তুঙ্গে । এ দাবি একান্ত যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক । কিংবা এর চেয়ে বেশী কিছু । সময়ের প্রয়োজনে এ দাবী এখন দিনে দিনে আরো জোরদার হওয়াই  স্বাভাবিক । সময়ের এ চিরন্তন দাবীটুকু মেটাতে জাতীয়করণের কাজটি অবিলম্বে সম্পাদন করা রাষ্ট্র ও সরকারের অপরিহার্য এক দায় । সময়ের কাজ সময়ে করার নাম সময়ানুবর্তিতা । কোন কাজ সময়মত না করলে এর জন্য যেমন জবাবদিহিতা থাকে , তেমনি বেগ ও পেতে হয় । খেসারত ও কম বেশী দেয়া লাগে। কথায় আছে-‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড় ।’
শিক্ষা ক্ষেত্রে সররকারের গৃহীত ইতিবাচক নানামুখি পদক্ষেপ কেবল সার্ক অঞ্চলে নয় , সারা বিশ্বে আমাদের ভাবমুর্তি উজ্জল করেছে । জাতিসংঘে পর্যন্ত আজ আমাদের শিক্ষা বিষয়ক নানা কার্যক্রম প্রশংসিত । পৃথিবীর বহু  উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত নানা কর্মসুচি এখন অনুসরণ করে । আমাদের শিক্ষামন্ত্রি আজ জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ভাইস প্রেসিডেন্ট । সে আমাদের শিক্ষায় গৃহীত নানা কর্মসুচির স্বীকৃতি । সারা দুনিয়া জুড়ে আমাদের গৌরব ও অহংকার ।
অবাক বিস্ময়ে পৃথিবীর অনেকেই ভেবে পায় না, কি করে বছরের প্রথমদিনে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামুল্যের পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে যায় ? তারা চিন্তা করে পায় না- এ কী করে সম্ভব ? প্রথম শ্রেণি থেকে ডিগ্রি স্তর পর্যন্ত উপবৃত্তি চালু করে সরকার সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে । ঘরে বসে আজ মোবাইল ব্যাংকিং-এর সহায়তায় উপবৃত্তির টাকা হাতে আসে । কেবল প্রাথমিক স্তরেই এক কোটি ত্রিশ লক্ষ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির আওতায় শিক্ষা সহায়তা পায় । তদুপরি আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে এখন অনেকের সন্দেহ ও নানা প্রশ্ন ।
পরিবর্তনের হাওয়া এখন সারা বিশ্ব জুড়ে । পৃথিবী এক জায়গায় বসে নেই । পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা আজ বিশ্বের ঘরে ঘরে প্রতিটি দেশে । এর সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি ‘শিক্ষা’ । দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী অবিসংবাদিত নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়-
‘ Education is the most powerful weapon that we can use to change the world.’ ( শিক্ষা হচ্ছে সব চেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার যা বিশ্বকে বদলে দেবার জন্য আমরা ব্যবহার করতে পারি ।)
যে জাতি যত শিক্ষিত , সে জাতি তত উন্নত । এ আমাদের সকলের জানা কথা । কিন্তু, দুনিয়ার কোন জাতি এমনি করে শিক্ষিত হয়ে ওঠেনা -সে আমরা অনেকে জানিনে । জাতিকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার জন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে মুখ্য ভুমিকা পালন করতে হয় । রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শিক্ষা তার কাঙ্খিত লক্ষ্য হাসিলে ব্যর্থ ।
আমাদের জাতির জনক সে উপলব্ধি থেকে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর জাতীয়করণ করেন । এরপর শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও পরবর্তি করণীয় নির্ধারণের জন্য কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন । কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের ! এ জাতি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা- চেতনার সুফল থেকে নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয় ।
জাতির জনক শেখ মুজিব একটা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ পেয়ে ও প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে দেখাতে চেয়েছেন, শিক্ষা জাতীয়করণে দেশ ও জাতির মঙ্গল সবচে’ বেশী । শিক্ষার জন্য যেটুকু ব্যয় – সে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ । আমাদের জাতির জনকের কাছ থেকে সে হিসেবের ধারণাটি আমরা পাই । দেশের উন্নয়ন ও সুশাসনের পূর্বশর্ত ‘শিক্ষা’ । তাই বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণে সর্বাগ্রে নাগরিকের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ প্রতীয়মান হয় । দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা যদি পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় , তবে জাতি এর সুফল স্বল্প সময়ের মধ্যে পেতে শুরু করে ।
শিক্ষা জাতীয়করণে বঙ্গবন্ধুর ধারাটি অব্যাহত রাখতে পারলে এতদিনে আমরা বহুদুর এগিয়ে যেতাম । আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৯৫% শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এখনো বেসরকারি । এর ফলে আমাদের গুরুত্বপুর্ণ এ দু’টি স্তরে অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা । মেধাবীরা এ স্তরে শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী নয় । এখানে বদলি কিংবা পদোন্নতি কোনটিই নেই । আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরটি জাতীয়কৃত হওয়ায় এখানে নতুন প্রজন্মের মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে উৎসাহ বোধ করেন । অনার্স-মাস্টার্স পাস করে ও অনেকে হাই স্কুল কিংবা কলেজে শিক্ষকতায়
 না গিয়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতায় যায় । এমনকি অনেকে হাই স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা নিয়ে চলে আসেন । এ হচ্ছে বাস্তব চিত্র ।  প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকদের কারণে সরকার এ স্তরটিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রসারিত করার সাহস করতে পেরেছে ।
বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীগণ এক প্রকার শেঁকলে আবদ্ধ থেকে সারা জীবন এক জায়গায় শিক্ষকতা করতে বাধ্য হন । তাদের জীবনে একবারের জন্য ও বদলি জোটে না । ফলে অনেককে একঘেঁয়েমি পেয়ে বসে । শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে কিংবা মানবিক কারণে ও তাদের বেলায় বদলি নেই । পদোন্নতি না থাকায় তাদের অনেকের সুপ্ত প্রতিভা জীবনে কোনদিন কোন কাজে লাগবার সুযোগ পায় না ।
শিক্ষায় কেন বেদরকারি শব্দ বেসরকারি কথাটি থাকবে । এ শব্দটি শিক্ষা ও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সরকারের অবহেলা ও উদাসীনতাকে নির্দেশ করে । আমাদের সরকার তো সে রকম ভাবে উদাসীন নয় । সরকার কোটি কোটি টাকা যেখানে ব্যয় করে, তা কী করে বেসরকারি হয়- সে অনেকের বোধগম্য নয় ।  সরকার শিক্ষক -কর্মচারীদের বেতন দেয় । কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে স্কুল-কলেজে দালান-বিল্ডিং নির্মাণ করে  । এতকিছুর পর ও এসব স্কুল-কলেজ বেসরকারি থাকে কীভাবে ?  তাহলে এ শব্দটি উঠিয়ে দেয়াই সমীচিন । অবিলম্বে কেবল এ অলক্ষুনে শব্দটি পরিহার করার জন্য সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করা প্রয়োজন ।
যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার বছরে  শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করে । আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারের ভুয়সী প্রশংসা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ-উন্নয়নের তিনটি প্রধান হাতিয়ার । শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্ততঃ দেশের সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করে সরকার সময়ের এ দাবীটি পুরণ করবে বলে আশা করতেই পারি । কেননা, বঙ্গবন্ধু জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন ‘স্বাধীনতা’ এনে দিতে পারলে তার ধ্যান-ধারণায় লালিত সরকার কেন জাতির সব স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের ছোট্ট স্বপ্নটি পুরণ করে দিতে পারবে না ?

[ মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071189403533936