জানতে হলে মুখস্থ নয়, বুঝতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

জানতে হলে মুখস্থ নয়, বুঝতে হবে

রহমান মৃধা |

মে, জুন, জুলাই ও আগস্ট--এ এক মজার সময়। এই সময় সুইডেনের প্রকৃতির বাহার, একই সাথে আবহাওয়া এতটাই সুন্দর হয়ে ওঠে, যা উপভোগ না করলেই নয়। মনে হচ্ছে, সুশিক্ষার ওপর লেখালেখি করার এক চমৎকার সময় এটা। আজকের লেখার বিষয়বস্তু হবে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এ খুবই প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী চলাচল, বেঁচে থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভালবাসার সেতু তৈরি করে সৌজন্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা এবং মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য। 

নিজেকে দিয়ে শুরু করি। এইচএসসি পাস করে উচ্চশিক্ষার্থে সুইডেনে আসি। সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়তে তখন (১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ) প্রয়োজন এইচএসসি বা বিএসসি পাস, সাথে TOEFL বা IELTS, স্কোর কমপক্ষে ৫০০, সাথে ৪০,০০০ সুইডিশ ক্রোনার প্রতিবছর ব্যাংকে থাকতে হবে। প্রথম ছয় মাস ভাষা শিখতে হবে এবং আমার ক্ষেত্রে সুইডিশ ভাষা শেখার মাধ্যম হবে ইংরেজি। এক বছরের মধ্যে শিখতে হবে সুইডিশ ভাষা এবং তারপর এই সুইডিশ ভাষাতে করতে হবে লেখাপড়া। নতুন জীবন শুরু হবে এই নতুন ভাষার মধ্য দিয়ে। ১৯৮৫-১৯৯০ এই পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে অংক, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার এগুলো পড়তে হয়েছিল সুইডিশ ভাষাতে। বুঝে, মুখস্থ করে নয়। তার পর চাকরি করা, বিয়ে করা, সামাজিকতা বজায় রাখা, সবই সম্ভব হয়েছে এই সুইডিশ ভাষাকে মাধ্যম করে। সুইডিশ ভাষা শেখার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। তা হলো, এই ভাষার মাধ্যমে সব কিছু জানতে হবে এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। যেমন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, পাতার ওপর যে দেশেই জল পড়ুক না কেন, পাতা নড়বেই, এ এক ইউনিভার্সাল ট্রুথ, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভাষার ভিন্নতা রয়েছে সত্যি, কিন্তু সামগ্রী এক এবং অভিন্ন। অন্যান্য ভাষার মত আরবি ভাষা শেখারও একটি গুরুত্ব রয়েছে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী আমাদের জন্য, কারণ পবিত্র কোরআন শরিফ আরবি ভাষাতে নাজিল হয়েছে। তাই আমাদের জন্য এ ভাষা শেখা বা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই বা থাকার কথা নয়।

আমার ভাবনা থেকে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জন্ম, ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর ওপর কোরআন শরিফ নাজিল হতে শুরু করে। তখন থেকে মুসলিমরা রাজ্য বিজয় ও ইসলাম প্রচারের জন্য দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকে শুরু হয় সারা মুসলিম বিশ্বে আরবি পড়া, মুখস্থ করা এবং শেখা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে আমি জানি না কতজন বাংলাদেশী মুসলিম পবিত্র কোরআন শরিফ পড়তে পারেন, বোঝেন? মুখস্থ বিদ্যা হিসাবে কোরআন শরিফের পরিচিতি এত বেশি যা পৃথিবীর অন্য কোন গ্রন্থের ক্ষেত্রে আছে বলে আমার জানা নেই। তবে এই পবিত্র কোরআন শরিফ বোঝার জন্য মুষ্টিমেয় লোক তাদের মত করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যুগ যুগ ধরে। কিন্তু কেন? জানা এবং বোঝার জন্যেই নিশ্চিত ছাত্ররা মাদ্রাসা বা বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। অথচ তাদের শিক্ষা হচ্ছে কি তেমন ভাবে, যেমনটি হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে আমি যখন পড়েছিলাম সুইডেনে? আমার প্রশ্ন, কেন শুধু ছেলেরা মাদ্রাসাতে পড়ছে? কেন খুবই কম সংখ্যক মেয়েরা পড়ছে সেখানে? তাদেরও তো সমপরিমাণ অধিকার রয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার? এসেছিলাম সুইডেনে শিক্ষা গ্রহন করতে, তাদের ভাষায় তাদের কথা বুঝতে, শিখতে, মুখস্থ করতে নয়।

 আজ বাংলাদেশের একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম, যেখানে মসজিদের আশেপাশে পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে এবং তার পাশে দেওয়ালে বাংলাতে লেখা রয়েছে “এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ”। অথচ বেশির ভাগ লোক প্রস্রাব করছে দেওয়ালের আশে পাশে। আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সেখানে নতুন এক ইনোভেটিভ চিন্তার উদয় হয়েছে, তারা বাংলায় ওই লেখাটা মুছে সেখানে আরবিতে লিখে দিয়েছে একই কথা। এখন কেউ আর প্রস্রাব করছে না দেওয়ালে। কারণ আরবি লেখা দেখেই সবাই প্রস্রাব না করে চলে যাচ্ছে। এটা একটি বড় সাফল্য বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছেন। আমার ভাবনা, যদি সবাই বুঝত লেখাটার মানে কী এবং মানে জানার পরেও মানুষ কি প্রস্রাব করত সেখানে?নিজের ভাষা বা নীতিবোধ ও অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করে অন্যের ভাষা বা অস্তিত্বের ওপর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। জানি না এ বিষয়ে কোন ধর্মে বা সমাজে তেমন কিছু বর্ণিত আছে কিনা! শুধু আরবি লিখা দেখে অনেকেই প্রস্রাব থেকে বিরত হলো। অথচ একই কথা লেখা ছিল মাতৃভাষাতেও। তা সত্বেও সবাই সেখানে প্রস্রাব করেছে। জেনে শুনে অন্যায় কাজ করা আর না জেনে অন্যায় কাজ না করা। ভয়? রেসপেক্ট ? না নীতি ও মূল্যবোধের অবনতি?

 বাংলাদেশে যে পরিমাণ মাদরাসা বা ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে কী শিক্ষা হচ্ছে? কীভাবে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে? তা আমি জানি না। তাই প্রশ্ন, সেখানে কি তেমন করে আরবি ভাষা শেখানো হয়, যেমনটি আমাকে সুইডিশ বিশ্ববিদ্যালয় শিখিয়েছিল? এক বছরের শিক্ষা আমাকে পুরো সুইডিশ ভাষা শিখতে সাহায্য করেছিল। যেভাবে সাধারণ সুইডিশ নাগরিকরা জীবন যাপন করে সুইডিশ ভাষার সাথে, ঠিক সেভাবেই শিক্ষা দিয়েছিল। তা যদি হয় তবে নিশ্চিত যারা আরবি লাইনে পড়াশোনা করছে, তারা সবকিছু বুঝে এবং জেনে শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং সব সাবজেক্টই তারা আরবিতে পড়ছে। আর তা যদি না হয় তবে আমার প্রশ্ন শুধু আরবি ভাষা শেখার জন্য তো আলাদা স্কুল কলেজ থাকার কথা নয়? আরবি ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি তো সাধারণত অন্য ভাষার মতই হবার কথা? ব্যতিক্রম হতে পারে, যদি কেউ ধর্ম নিয়ে গবেষণা করে বা ধর্মীয় প্রফেশনের সাথে সংযুক্ত থাকতে চায় অথবা যদি আরবিতে সব সাবজেক্টই পড়ানো হয়, যেমন অংক থেকে শুরু করে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি। আরবিতে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে যদি অর্থ বোঝানো বা শেখানোর পদ্ধতি না জানা থাকে, তাহলে সে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সত্বর কার্যকর সুশিক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে, তা নাহলে এ শিক্ষা জাতির জন্য উপযোগী হবে না। হবে না ধর্ম শিক্ষার প্রতিফলন, হবে না তার মূল উদ্দেশ্য সফল।

না বুঝে বা মুখস্থ করে পড়লে কী হয়, এবার সে বিষয়ে কিছু লিখি। আমাদের মন একটি চলমান অনুভূতি, যাকে এক জায়গায় ধরে রাখা কঠিন। যদি মুহূর্তটি আনন্দময় না হয় বা বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হয় মনের ওপর। একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমরা যখন নামাজ পড়ি পাঁচ ওয়াক্ত, নামাজের সাথে কতগুলো সুরা মুখস্থ পাঠ করি, ভাবুন নামাজের মধ্যের সময় মনের মধ্যে কত ধরনের কথা উদয় হয়। কীভাবে আমাদের মন দেশবিদেশ বা দৈনন্দিন জীবনের অনেক স্মৃতিচারণ করে? মনকে এক জায়গাতে ধরে রাখা বিরাট কঠিন ব্যপার। “হেয়ার এ্যন্ড নাও” কনসেপ্টের মধ্য দিয়ে মনকে কন্ট্রোলে রাখতে দরকার কলুষতা মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত এবং দুশ্চিন্তামুক্ত মন রাখা এবং অবস্থার সাথে অ্যাডজাস্ট করার কৌশল তৈরি করা। এই কৌশল তৈরি/সৃস্টি করতে হলে দরকার প্রশিক্ষণের। যেহেতু সুশিক্ষার জন্য সংগ্রাম তাই এই প্রশিক্ষণ পেতে হলে জানতে হবে, জানতে হলে শিখতে হবে, শিখতে হলে মন দিয়ে পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে, সাথে “হেয়ার এ্যান্ড নাও কনসেপ্ট” ব্যবহার করতে হবে। সোনার বাংলা পেতে হলে ক্রস ফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধ নয়, এ শুধু সমাজে ঘৃণা এবং প্রতিশোধমুলক আচরণ সৃষ্টি করবে, বাড়বে অরাজকতা, অবনতি হবে গণতন্ত্রের। দরকার সুশিক্ষার এবং সুস্থ্ পরিচালনার। ম্যানেজমেন্ট বাই থ্রেট্স নয় দরকার ম্যানেজমেন্ট বাই অবজেকটিভস এবং তার জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের, যেখানে মুখস্থ নয় জানার জন্য শিক্ষা প্রদান করা হবে।

 

লেখক : সুইডেন প্রবাসী।

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032849311828613