জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বর্তমান আলোচনা ও শিক্ষার্থীদের একাংশের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মাস্টারপ্ল্যান সংক্রান্ত কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি, যা এ সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করবে এবং প্রসঙ্গটিকে খণ্ডচিত্র আকারে উপস্থাপনের অপ্রাসঙ্গিকতাও প্রকাশ করবে। এই নিবন্ধে দুটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ কর্তন এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট পুঞ্জীভূত সমস্যার চিত্র উপস্থাপন। দ্বিতীয়ত, মাস্টারপ্ল্যান ও অধিকতর উন্নয়ন সংক্রান্ত আলোচনা। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
ব্যক্তিগত কারণে ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো আমার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সুযোগ হয়। সে সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। কতগুলো কৃত্রিম লেক তৈরির কাজ তার কিছু আগে শেষ হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সরকারি ও এনজিও কার্যক্রমের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফাঁকা স্থানে বৃক্ষরোপণ করে। এই বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম কখনোই পরিকল্পিতভাবে কিংবা বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যানকে বিবেচনায় নিয়ে করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি যে ব্যাচে (২০তম) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম; ঢাকা রোটারি ক্লাবের সহায়তায় সেই ব্যাচের পক্ষ থেকে ১৯৯৬ সালে ডেইরি ফার্ম গেট (বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক) থেকে বর্তমান শহীদ মিনার পর্যন্ত সড়ক বিভাজনে অনেক ঝাউ-দেবদারু গাছ লাগানো হয়। পরে মাস্টারপ্ল্যানে থাকা শহীদ মিনার নির্মাণ করা ও শহীদ মিনারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে দৃশ্যমান করার যুক্তিতে প্রায় ১৫ বছরের পুরনো সেসব ঝাউ-দেবদারু গাছ তৎকালীন প্রশাসন কর্তন করে। এ কাজের সঠিকতা বিচার করা অত্যন্ত জটিল কাজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বনায়নের আওতায় যে গাছ লাগানো হয়, তার মধ্যে একটি প্রধান প্রজাতি ছিল একাশিয়া, যার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব যখন জানা যায়, তখন অনেক গাছ কর্তন করা হয়। এ প্রজাতির অসংখ্য গাছ এখনও ক্যাম্পাসে বিদ্যমান। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে সেটি হলো, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না হয়। এতে খণ্ডিত উন্নয়নের ফলে প্রতিবেশের একক নিরবচ্ছিন্ন সত্তা হারিয়ে যায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া, বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খল বাধাগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রমকে রোধ করা যায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উন্নয়ন পরিকল্পনাটি বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন পরিকল্পনার আলোকে প্রণয়ন করেছেন। তা বাস্তবায়িত হলে পরিবেশের ক্ষতি কম হবে এবং গ্রিন জোন (যেটি বর্তমান পরিকল্পনায় রাখা আছে) তৈরির মাধ্যমে প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েরও চলমান উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে বৃক্ষরোপণসহ অন্যান্য পরিকল্পনা রয়েছে। একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা স্তরের মান নির্দেশক সূচকগুলো উন্নয়নের অন্যান্য সূচক যেমন জিডিপি, মাথাপিছু গড় আয়, দারিদ্র্য বিমোচন, জন্মহার, খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদির সঙ্গে সমান তালে এগোতে পারছে না। এর অসংখ্য কারণের মধ্যে একটি হলো শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি। তাই চলমান অধিকতর উন্নয়ন পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
মাস্টারপ্ল্যান সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট বেশ কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত প্রয়োজন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ৭৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১৯৬৮ সালে প্রস্তুতকৃত মাস্টারপ্ল্যানের সুপারিশ মোতাবেক বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়। পরবর্তীকালে অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হওয়ার আগেই অপরিকল্পিতভাবে বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারোপযোগী ভূমির পরিমাণকে সীমিত করে ফেলে। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মাত্র ২১ শতাংশ ভূমি ব্যবহারযোগ্য রয়েছে। অধ্যাপক ইসলামের উপাচার্য হওয়ার আগে অপরিকল্পিতভাবে বিভাগ খোলার কারণে ছাত্রছাত্রীদের যে আবাসন সংকট তৈরি হয়েছে, তার ফলে ব্যবহারোপযোগী এই ২১ শতাংশ ভূমির মধ্যেই অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে বুয়েট কর্তৃক মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ (পরিকল্পনাবিদসহ) নিয়োজিত ছিলেন। মাস্টারপ্ল্যান করার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপকসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সুতরাং কারও সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি- এ কথা সঠিক নয়। এ বিষয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি।
একটি নগরের নাগরিক সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে তৈরি মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের তুলনা করা সঠিক নয়। একটি মাস্টারপ্ল্যান সাধারণত ২০ বছরের জন্য তৈরি হয়। এটি তৈরি হওয়ার পর কোনো বিশেষ প্রয়োজনে অথবা মাস্টারপ্ল্যানের জন্য নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হলে মাস্টারপ্ল্যান রিভাইজ করা হয়, যা একটি প্রচলিত ও চলমান প্রক্রিয়া। মাস্টারপ্ল্যান বিভিন্ন সেক্টরের জন্য করা হয়ে থাকে। যেমন নগর পরিকল্পনা, পানি ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও শক্তি, কৃষি সংক্রান্ত ইত্যাদি। সেক্টরের ভিন্নতর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয় বিষয়াদি বিবেচনা করে এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। একইভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান তার জন্য উপযোগী কতগুলো সূচক, মান ও প্রাসঙ্গিক বিষয় সামনে রেখে করা হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সার্ভিস সংক্রান্ত বিষয়, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষকদের আবাসন এবং এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচ্য। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা করা হয়। সুতরাং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ও গবেষণার সুবিধাদি নিশ্চিত করা সামনে রেখে তৈরি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান নগর পরিকল্পনার লক্ষ্যের সঙ্গে তুলনা করা অপ্রাসঙ্গিক ও সামঞ্জস্যহীন।
বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনা ব্রিটিশ প্ল্যানিং প্র্যাকটিসের আদলে বিভিন্ন ধাপ, স্কেল ও প্ল্যানিং স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতে করা হয়। নগর পরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপ থাকে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই তৈরিকৃত মাস্টারপ্ল্যানে এই ধাপের পর্যায়ক্রমিক প্রতিফলন সম্ভব নয়। সুতরাং নগর পরিকল্পনার জন্য তৈরিকৃত কর্মপরিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের জন্য তৈরি করা কর্মপরিধি এক বিষয় নয়। বিষয়টি হলো, যে সেক্টরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে, সেটিকে বিবেচনায় রেখে তার কর্মপরিধি তৈরি হয়েছে কি-না। মাস্টারপ্ল্যান তৈরির আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পরিকল্পনা ও উন্নয়ন' কমিটিতে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতিকে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সে সময় ওই বিভাগে প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজিত থাকায় বিভাগীয় সভাপতিকে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সার্ভে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে করা হয় এবং তারা তাদের মতো তা সম্পাদন করেছে। পরবর্তীকালে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প একনেক থেকে অনুমোদিত হতে সাহায্য করেছে, যেটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আমাদের এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ে মতবিরোধ থাকে। যার কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগকে পরিকল্পনা প্রণয়নে সংযুক্ত করলে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, যা প্রকারান্তরে এ পরিকল্পনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এ বিবেচনায় তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের প্রাচীন, নির্ভরযোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটকে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ দেওয়া নিরপেক্ষ ও সমীচীন। মাস্টারপ্ল্যান কখনোই শত বছরের জন্য হতে পারে না। কারণ পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিত্যনতুন উপাদানের উদ্ভব, সংযোজন-বিয়োজন এবং তাদের পারস্পরিক মিথস্ট্ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন জটিল সমীকরণ শত বছরের ব্যাপ্তিতে চিন্তা করার চেষ্টা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর প্রায়োগিকতার অপ্রাসঙ্গিকতার কারণে সারাবিশ্বের কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একশ' বছরের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কোনো নজির নেই। বর্তমান সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও আগ্রহের কারণে প্রাপ্ত এই উন্নয়ন পরিকল্পনাটি সঠিকভাবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় উন্নয়নে আরও দৃঢ় ও কার্যকরভাবে অবদান রাখতে সাহায্য করবে।
ড. শেখ তৌহিদুল ইসলাম : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং অ্যান্ড জিআইএস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।