দেশের অন্য যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য আলাদা। কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ আবাসিক। বিশ্ববিদ্যালয়টির চারদিকে সবুজের সমারোহ। আছে নানা প্রজাতির গাছ, ফুল, ফল, লেক, পুকুর, পাখিসহ নানা প্রাকৃতিক আয়োজন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালটির বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের সমস্যা। এ নিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দুটি গ্রুপ। উপাচার্যপন্থীরা বলছেন, মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী উন্নয়নকাজ হচ্ছে। আর আন্দোলনকারীরা বলছেন, এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে গেলে কাটতে হবে হাজার হাজার গাছ। প্রাকৃতিক চরিত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির যে আদল, তা বিনষ্ট হবে। শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন ও শুভ আনোয়ার।
পত্রিকার পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে মহাপরিকল্পনা নিয়ে পাওয়া গেছে মহাগলদ। যে মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে তা মাস্টারপ্ল্যান না। মূলত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য কিছু খালি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ কমবে, নষ্ট হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কত ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে বিন্যস্ত করে দেখানো হয়নি। অথচ এ বিষয়গুলো একটি পূর্ণাঙ্গ, কার্যকর ও টেকসই মহাপরিকল্পনার পূর্বশর্ত।
যদিও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালামকে সভাপতি করে ১৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু কমিটিকে সুনির্দিষ্ট কোনো কাজের দায়িত্ব না দেয়ায় তারা একটি সভা ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি।
অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালাম বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানে সাধারণত ডিটেইল ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান, ড্রেনেজ, রোড সার্কুলেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ
নানা বিষয় থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে এসব অনুপস্থিত। আগে আমাদের একটা পুরনো মাস্টারপ্ল্যান ছিল। কিন্তু এরপর যে সব স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে সেখানে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হয়নি। এখন যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে সেখানে লোকেশনটা চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে না। আমরা যদি কাজগুলো সত্যিকার অর্থেই করতে চাই, ক্যাম্পাসের কথা চিন্তা করে পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ীই করা উচিত।’
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান করেছে বলে যেটা দাবি করা হচ্ছে, সেটা আসলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না। আজ হোক বা কাল হোক পূর্ণাঙ্গ একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতেই হবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কিছু প্রস্তাব দিয়েই তো সরকারের কাছ থেকে টাকাটা পাওয়া গেছে। সেই ব্যয়টা কোথায় কোথায় হবে তার একটা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা মাস্টারপ্ল্যান না। পরিপূর্ণ মাস্টারপ্ল্যান করতে সময় লাগে, অনেক ধরনের স্টাডি লাগে। এগুলো এখানে করা হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান করার জন্য একটা উপযুক্ত টেকনিক্যাল টিম বা কমিটি থাকা দরকার—যেখানে প্ল্যানার থাকবেন, আর্কিটেকচার থাকবেন, ভূগোলবিদ থাকবেন, পরিবেশবিদ থাকবেন, নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞ থাকবেন।’
আন্দোলনকারী বিএনপিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক জামাল উদ্দীন বলেন, ‘আমরা মনে করি যে সমস্যা চলছে তা রাস্তায় নয়, টেবিলে বসে সমাধান হতে পারে। মাস্টারপ্ল্যান এক্সপার্ট লেভেলে রিভিউ করতে হবে, যা বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে করতে হবে। সমস্যা সমাধানে প্রথমত উপাচার্যকে তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। এর মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয় বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলকে ঘিরে যে তিনটি হল করা হচ্ছে এই তিনটি স্থানান্তর করতে হবে। এটা আমাদের প্রথম দাবি। এই দাবি মেনে নিলে একটি সমস্যার সমাধান হবে। মাস্টারপ্ল্যান একটি দীর্ঘদিনের বিষয়। কারণ প্রতি দিন তো মাস্টারপ্ল্যান করে কাজ করা যাবে না। তাই মাস্টারপ্ল্যানটির পুনর্মূল্যায়নের বিকল্প নেই। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনের অংশগ্রহণ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে আলোচনা করে এটাকে চূড়ান্ত করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, ‘আমরা আশাবাদী খুব তাড়াতাড়ি এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা যখন তাদের সঙ্গে বসব, তখন তাদের যা অস্বচ্ছ ও অপরিকল্পিত মনে হবে সে বিষয়ে আরো কাজ করব। মাস্টারপ্ল্যানের আর্কিটেক্ট অধ্যাপক আহসান উল্লাহ মজুমদারের সঙ্গে বসব। তিনি যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন সেভাবে কাজ করব।’