জামিলুর রেজা চৌধুরী : দুলাভাই, শিক্ষক, গুরু এবং বস - দৈনিকশিক্ষা

জামিলুর রেজা চৌধুরী : দুলাভাই, শিক্ষক, গুরু এবং বস

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমার বয়স তখন ১৫ বছর। আমি দিল্লিতে স্কুলে, একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। কয়েক মাস আগে তিনি আমার বোনকে বিয়ে করেছেন, কিন্তু আমি সেই বিয়েতে হাজির থাকতে পারিনি। রোববার (৩ মে) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ফুয়াদ এইচ মল্লিক।

আমার বাবা, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন, তিনি ঢাকায় ফিরে বোনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেন। আমি দিল্লির পাবলিক স্কুলের হোস্টেলেই রয়ে যাই।

জামিল ভাই ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, ফেরার পথে তাঁর শ্যালককে দেখতে দিল্লিতে থামেন। তিনি জানতেন যে আমার একটি বিষয় হিসাবে প্রযুক্তিগত অঙ্কন ছিল। সে কথা মাথায় রেখে আমাকে এক সেট অ্যাডজাস্টেবল স্কোয়ার (ব্লুন্ডেল ও হার্লিং) উপহার দিয়েছিলেন। তখনকার বিবেচনায় ওটা নতুন একটা জিনিস। দীর্ঘকাল এই জিনিসটি আমার গর্বের জিনিস হয়ে ছিল, এমনকি আর্কিটেকচারে স্নাতক পড়ার সময় এবং তার পরও এই সেট আমি সঙ্গে রেখেছি। এই নতুন জিনিসটির আমার কাছে এর একটা অন্যরকম তাৎপর্য আছে: এর মধ্যে তার ব্যক্তিত্ব, শিক্ষার প্রতি এবং নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে আগ্ৰহের কথাই বলে, এই প্রযুক্তির প্রতি আগ্ৰহই তাকে বুয়েটে প্রথম কম্পিউটার কেন্দ্র শুরু করতেও আগ্ৰহী করেছিল ।

আমি তাঁকে দুলাভাই, একজন শিক্ষক, সহকর্মী এবং শেষ পর্যন্ত আমার বস হিসেবে জানতাম। আমি যখন এইচএসসির ছাত্র ছিলাম, তখন তিনি আমাকে ম্যাট্রিক্স শিখিয়েছিলেন। বুয়েটে ছাত্র থাকাকালীন তিনি আমাকে নানা বই পড়ার জন্য দিতেন, যার মধ্যে তাঁর দেওয়া একটা বই আমার ওপর দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল এবং আজও ওটা আমার প্রিয় হয়েই আছে। বইটি ছিল বিখ্যাত মিশরীয় স্থপতি হাসান ফাতির ‘আর্কিটেকচার ফর দ্য পুওর’। আর্কিটেকচারের ছাত্র হিসেবে আমি তাঁর কাছে কাঠামোগত পরামর্শের জন্য যেতাম এবং আমি এফ আর খানের টিউবুলার স্ট্রাকচার, টিউব ইন টিউব স্ট্রাকচার, ক্রস বন্ধনীগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতাম। আমি তাঁর বাসাতেই প্রথম হোম কম্পিউটার দেখি (একটি কমোডর মডেল)।

পরে, আমি বুয়েটে প্রভাষক হয়েছি এবং তিনি এক অর্থে আমার সহকর্মী হলেন, কিন্তু তিনি আমার চিরকালের গুরুই। আমার একটা বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, আমার এরকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি ছিল যে, তিনি বুয়েটে শিক্ষার্থী হিসাবে আমার পদ্ধতিগুলো অনুমোদন করেননি, যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অনেক সদস্য যাঁরা আর্কিটেকচার শিক্ষার্থীদের গুরুত্বের সঙ্গে নেন না বলে মনে হয়। তিনি আমাকে খেলাধুলায় আগ্রহী করার চেষ্টা করেছিলেন, আমি এতে ভালো ছিলাম না। তিনি আমাকে প্রথম সেট আঁকার কলম উপহার দিয়েছিলেন। তিনি প্রায়শই আমার পড়াশোনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, আমি ভয় পেতাম, কারণ আমার মনে হত, তিনি এমন কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন, যার উত্তর আমার কাছে নেই। তবু আমি কোনোমতে উত্তর দিতাম। যখন বুয়েটে নতুন ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে আর্কিটেকচারের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালেন, তখন তিনি আমাদের ঠান্ডা করার জন্য আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটিকে একটি চ্যানেল হিসাবে ব্যবহার করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

আমি রাজি হইনি এবং আমি অনুমান করি যে সে সময়েই তিনি আমাকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছিলেন। যেদিন আমি প্রফেসর ইকবাল মাহমুদের (তৎকালীন বুয়েটের ভিসি) অফিসে গিয়েছিলাম আমার পদত্যাগপত্র (১১ জানুয়ারি ১৯৯৯) দেওয়ার জন্য, তিনি সঙ্গে সঙ্গে জামিল ভাইকে ফোন করলেন এবং দুজনই আমাকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি অটল ছিলাম এবং আমি বুয়েট ছেড়েছি। আমি তখন বিদেশে পড়াতে গিয়েছিলাম, তবে আমার মন ছিল বাংলাদেশে এবং এখানে আর্কিটেকচার পড়ানোয়।

সুতরাং, যখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমি ছুটিতে ফিরে এসেছি কিন্তু আর ফিরে যাইনি। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কি কোনো আর্কিটেকচার বিভাগ শুরু করতে চান? তিনি আমাকে বোর্ডে উপস্থাপন করতে বলেছিলেন। আমি স্যার ফজলে হাসান আবেদের সামনে উপস্থাপন করতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার ওপর আস্থা রেখে আমাকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন। পরের কয়েক মাস খেটে আমি পাঠ্যক্রমটি নামিয়েছি, আমার কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে পরামর্শ করেছি, যারা বুয়েট ছেড়েছিল। এবং বিভাগটির ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্লাস শুরু হয়।

জামিলুর রেজা চৌধুরী তখন আমার বস এবং খুব সহায়ক। পরের ৮ বছরে এই লোকটিকে আমি আরো গভীর ভাবে জানলাম, কেন সবাই তাঁর প্রশংসা করেন! তাঁর বড় গুণের মধ্যে ছিল তিনি ধৈর্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে অন্যের কথা শুনতেন, বিজ্ঞ পরামর্শ দিতেন এবং ভালো কোনো কিছুকে মুক্তহস্তে সহায়তা দিতেন। তাঁর বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

তিনি বহু বছর পরও প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের নাম ধরে চিনতেন। তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতি সম্পর্কে সবাই জানত। তিনি আমাকে প্রচুর দায়িত্ব, ভর্তি পরীক্ষা, প্রথম সমাবর্তন আয়োজনসহ অনেক দিয়েছেন। আমি তাঁর কাছে ব্যর্থ হাওয়ার ভয়ে সব সময় সফল হয়েছি। আমি তাঁর আগ্ৰহেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম শুরু করি। আমি আর্কিটেকচারের শিক্ষক ছিলাম, ডিজাস্টার মেনেজমেন্ট বিষয়ে আমার তেমন ধারণাই ছিল না, কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা ছিলেন (কেন এখনো তা বুঝতে পারি না) তবে আমি নতুন কিছু শিখি। এ ব্যাপারটা আমার জন্য কিছুটা অ্যাডজাস্টেবল সেট স্কয়ারের মতো ছিল। তিনি আমাকে একটি নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি স্বীকার করি শুরুতে এ প্রোগ্রামটি চালু করতে তাঁর নাম প্রচুর ব্যবহার করেছি। বলতে দ্বিধা নাই এই অঞ্চলে এটাই এই জাতীয় প্রথম প্রোগ্রাম, তিনিই ছিলেন তার জেনারেল আমি ছিলাম এক পদাতিক সৈনিক মাত্র।

তাঁর কাছ থেকে প্রচুর শিখেছি, তিনি বলতেন—মানুষের কথা শুনো, মানুষের ওপর বিশ্বাস এবং ভরসা রেখো, পটভূমি গবেষণা করো, কখনো ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করো না এবং হাসো।

কাজের ক্ষেত্রে, আমার বস হিসাবে তাঁর কাছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি: যদি বিষয় ঠিকঠাক হয়, তবে স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করবে না, কিন্তু যদি ভুল হয়ে যায়, তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধন করো। আমি তাই অনুসরণ করে আসছি এবং এখনো করছি।

তিনি আমার দুলাভাই, এটি পারিবারিক সম্পর্ক। তিনি যখন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সুস্পষ্ট কারণেই আমার প্রথম চিন্তাটি এল আমার বোন, ভাগনে এবং ভাগনির জন্য। একটু পর আমার প্রথম অনুভূতি ছিল এ মৃত্যুকে অস্বীকার করার। তারপর এক গভীর শূন্যতা বোধ আমাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনল। তিনি সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

* লেখক: ডিন, আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজাইন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।

(ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন ইফতেখার আহমেদ)

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042769908905029