গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (জিসিআই) আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘জিপিএ-৫ এর নামে বাচ্চাদের ওপর এখন নির্যাতন চলছে।' এর আগেও এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী একই সুরে বলেছিলেন, ‘আমাদের শিশুরা জিপিএ-৫ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’
মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমরা কতটা একমত সে বিষয়ে যাওয়ার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উপর একটু দৃষ্টি দেই। যেমন-এবার ৩৮তম বিসিএসে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। দুই হাজার ২৪টি শূন্যপদের বিপরীতে এবার আবেদন করেছেন তিন লাখ ৮৯ হাজার পরীক্ষার্থী। লিখিত পরীক্ষায়ও এবার প্রায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন, যা যেকোনো বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের দিক দিয়ে রেকর্ড।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশঙ্কা জনকভাবে কমে যাচ্ছে। ব্যানবেইস-এর পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চমাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর ২০০২ সালে তা বেড়ে হয় ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তারপর আবার পতনের শুরু এবং ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তা নেমে আসে শতকরা ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে।
আজকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক পড়াশোনার তুলনায় বিসিএস প্রস্তুতির পড়া বেশি পড়ে। যারা বিসিএস ক্যাডার হতে পারে না, তারা যেকোনো ভাবেই হোক একটা সরকারি চাকরি চায়। বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে, তার পেছনেও কিন্তু রয়েছে সেই চাকরি করার প্রবণতা! শিক্ষার্থীরা মনে করে, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা চাকরির সুযোগ সীমিত। গবেষকরা বলেন, বিজ্ঞান বিষয়ের জ্ঞান প্রতি পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়। তাহলে আর বাড়তি পরিশ্রম করে বিজ্ঞান পড়া কেন?
আমাদের শিশুরা কেন জিপিএ-৫ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার উত্তর রয়েছে ৭ সেপ্টেম্বর আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যের মধ্যে। ‘পরিবর্তিত হও : ছকের বাইরে ভাবো’ শিরোনামে আয়োজিত এ সিম্পোজিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই ছিল তরুণদের মধ্যে সফল উদ্যোক্তা তৈরি করা। অর্থাত্ বর্তমানে আমাদের তরুণরা উদ্যোক্তা হতে চায় না। তারা চাকরি করতে চায়। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের সকল ধরনের সৃজনশীল চর্চা থেকে দূরে রেখে জিপিএ-৫ পাওয়াতে ব্যস্ত, কারণ তারা তাদের সন্তানদের জন্য চাকরি চান। আর সেটা যে সরকারি চাকরি, তা বলাই বাহুল্য।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, শিক্ষাকে আমরা ভালো চাকরির অস্ত্র হিসেবে দেখছি। অথচ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ এবং পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে আমাদের দরকার উত্পাদন ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি। মেধাবীরা সবাই যদি চাকরি করে তাহলে উত্পাদন ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে কারা যাবে?
একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি তা বাস্তবায়নের পথে আমাদের সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ। আমাদের মেধাবী তরুণদের ভবিষ্যতে শুধু চাকরি করার প্রবণতা থেকে বের করে এনে তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখানোটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে শুধু জিপিএ-৫ অর্জনের জন্য তাদের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করি, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা শুধু চাকরিজীবীই পাব— চাকরিদাতা নয়!
লেখক : উপাধ্যক্ষ, দ্য কার্টার একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চাঁদপুর
সৌজন্যে: ইত্তেফাক