জিপিএ-৫ পেল স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া প্রতিবন্ধী মেয়েটি - দৈনিকশিক্ষা

জিপিএ-৫ পেল স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেয়া প্রতিবন্ধী মেয়েটি

যশোর প্রতিনিধি |
বাড়ির পাশেই স্কুল। কিন্তু এক শিক্ষকের অমানবিক আচরণে স্কুল ছাড়তে হলো শারীরিক প্রতিবন্ধী জ্যোতি হোসেনকে। এক কিলোমিটার দূরের আরেক স্কুলে এক মানবিক শিক্ষক তাকে বুকে টেনে নিলেন। এক বছর ধরে হুইলচেয়ার ঠেলে স্কুলের দূরত্বকে কাছে টেনে নিলেন মা রেক্সোনা হোসেন।
 
হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে চলা জ্যোতি এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। শ্রুতিলেখক হয়ে ছোটবোন জেবা হোসেনও তার সংগ্রামের সঙ্গী। জ্যোতির সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হলেন মা রেক্সোনা। কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠলো তার।
 
জ্যোতি হোসেন এ বছর যশোরের ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ঝিকরগাছা পৌরসভার পারবাজার মাস্টারপাড়া এলাকার মালয়েশিয়াপ্রবাসী কাদের হোসেন ও গৃহিণী রেক্সোনা হোসেনের দুই মেয়ের মধ্যে জ্যোতি বড়। পাঁচ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় চলনশক্তি হারিয়ে ফেলে জ্যোতি। মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত কোনো শক্তি পায় না সে। তাই হুইলচেয়ারই তার ভরসা। সেই হুইলচেয়ারে বসেই অদম্য মেধার স্ফুরণ ঘটিয়েছে মেয়েটি।
 
একটু ধাতস্থ হয়ে স্মৃতির ভান্ডার মেলে ধরেন আবেগতাড়িত মা রেক্সোনা হোসেন। ফিরে যান প্রায় একযুগ আগে। জ্যোতির তখন পাঁচ বছর বয়স। বেড়াতে গিয়ে ভ্যান থেকে পড়ে যায় সে। মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ায় পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত শরীর একরকম অচল হয়ে যায়। ঢাকা, ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে তার চিকিৎসা করানো হয়। সর্বশেষ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে। সেখানে চিকিৎসা চললেও জ্যোতির হাত, পা ও শরীর অচলও রয়েছে।
 
সেই থেকে মেয়েকে নিয়ে সংগ্রাম শুরু রেক্সোনা হোসেনের। মেয়েকে ভর্তি করেন পারবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ৫ম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পায় জ্যোতি। তার বাড়িতে ছুটে যান ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সদ্যপ্রয়াত লিয়াকত আলী ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন মুকুল। উদ্দেশ্য মেয়েটিকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করানো। মেয়েকে পাইলট স্কুলে ভর্তির ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় রেক্সোনার সামনে।
 
বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব পাইলট স্কুলের। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি; পাঁচ বছর কীভাবে মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া করবেন। বাধ্য হয়ে বাড়ির পাশে পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জ্যোতিকে ভর্তি করেন মা রেক্সোনা। এই স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষা দিলেও জিপিএ-৫ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় সে। এ কারণে জ্যোতির ছোট বোন মেধাবী জেবা হোসেনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন রেক্সোনা। জেবাও তখন পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী।
 
ছোট মেয়ে জেবা ৮ম শ্রেণিতে উঠলে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করে দেন রেক্সোনা হোসেন। জ্যোতি তখন সবে ১০ম শ্রেণিতে উঠেছে। জেবাকে স্কুলে না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান। তিনি মা রেক্সোনা হোসেনকে জানিয়ে দেন, ছোট মেয়ে জেবাকে স্কুলে না পেলে বড় মেয়ে জ্যোতিকেও তিনি স্কুলে রাখবেন না। শিক্ষকের এমন আচরণে কষ্টে বুক ভরে ওঠে রেক্সোনার। দ্বিধাগ্রস্ত রেক্সোনা পাশে পান চার বছর আগে তার বাড়িতে যাওয়া পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক লিয়াকত আলীকে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১০ম শ্রেণিতে জ্যোতিকে পাইলট স্কুলে ভর্তি করে নেন তিনি।
 
এক বছর ধরে হুইলচেয়ারে করে প্রতিদিন এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ঠেলে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গেছেন রেক্সোনা। বাড়িতে শিক্ষক রেখে মেয়েকে পড়িয়েছেন। অবেশেষে জিপিএ-৫ পেয়েছে মেয়েটি।
 
অশ্রুসিক্ত রেক্সোনা হোসেন সদ্যপ্রয়াত পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক লিয়াকত আলীকে স্মরণ করে বলেন, পারবাজার স্কুল যখন আমার অচল মেয়েটিকে দূরে ঠেলে দিল, লিয়াকত স্যার তখন তাকে বুকে টেনে নিলেন। স্কুলে ভর্তি করলেন। তখন ওই স্কুলে ১০ম শ্রেণির ক্লাস দোতলায় হতো। জ্যোতির জন্য সেই ক্লাসকে নিচতলায় নামিয়ে আনলেন। স্কুলে হুইলচেয়ার আনা-নেয়া সহজ করার জন্য স্লাব করে দিলেন। নিজের সন্তানের মতো খেয়াল রেখে লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করলেন। গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর এই শিক্ষক ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তার জন্য দোয়া করছি আমরা।
 
ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন মুকুল বলেন, অত্যন্ত মেধাবী জ্যোতি হোসেন হুইলচেয়ারে করেই স্কুলে যাতায়াত করেছে। পারবাজার স্কুলের অমানবিক আচরণের কারণে তার মা তাকে পাইলট স্কুলে নিয়ে আসেন। তার মা-ই তাকে স্কুলে আনা-নেয়া করতেন। প্রতিবন্ধী হওয়ায় মেয়েটির লেখাপড়ার প্রতি সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখিয়েছি আমরা। দোতলার ক্লাসকে নিচতলায় এনেছি। বাড়তি কেয়ার নিয়েছি। শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে জ্যোতির ছোট বোন জেবাকে পরীক্ষার জন্য শ্রুতিলেখক হিসেবে অনুমোদন করিয়ে এনেছি। এসএসসি পরীক্ষায় বোনের পাশে বসে লিখে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংগ্রামের অংশ হয়েছে জেবা।
 
এসএসসির এই ফলাফলে খুশি জ্যোতি হোসেন জানায়, লেখাপড়াই আমার সবকিছু। পড়াশোনা করতে না পারলে আমার খুব খারাপ লাগে। পারবাজার স্কুল থেকে যখন চলে আসতে হলো তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু জিপিএ-৫ পাওয়ায় সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। আমি লেখাপড়া করে আইনজীবী হয়ে অসহায় মানুষকে আইনি সেবা দিতে চাই।
 
জ্যোতি হোসেনের মা রেক্সোনা হোসেন জানালেন, জ্যোতি এসএসসি পাস করলেও সামনে তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত। এখন মেয়েকে কলেজে ভর্তি করতে হবে। আবার চিকিৎসাও অব্যাহত রাখতে হবে। তাই এ নিয়ে আমার চিন্তায় ঘুম আসে না।
 
তিনি আর বলেন, ডাক্তাররা যেহেতু বলেছেন সঠিক ও পরিপূর্ণ চিকিৎসা হলে জ্যোতির হাত-পা সচল হতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমার অসহায় মেয়েটির দিকে দৃষ্টি দেন, আর আল্লাহ যদি মেয়েটিকে সুস্থ করেন, তাহলে সেদেশের বোঝা নয়, সম্পদ হতে পারে।
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036799907684326