শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত রংপুরে চরম আবাসন সংকটে পড়েছে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী। তার ওপর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে মেস মালিকরা হু হু করে মেসের সিট ভাড়া বৃদ্ধি করছে। এতে প্রায় দিনই মালিকদের সঙ্গে বাগিবতণ্ডায় জড়াতে বাধ্য হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে নামিদামি সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও প্রয়োজনীয় আবাসন সুবিধা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। পর্যাপ্ত আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় মেস মালিকদের খপ্পরে অসহায় হয়ে পড়তে হচ্ছে তাদের। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন স্বপন চৌধুরী।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রংপুর শহরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় এক হাজার ছাত্রাবাস নিজেদের তৈরি করা নিয়মে চলছে। সেখানে নিত্যদিনই ঘটছে চাঁদাবাজি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের ঘটনা। এমন পরিবেশে নিজেদের অনিরাপদ মনে করছে নিবাসগুলোর শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ছাত্রীনিবাসগুলোর বাসিন্দারা। তাদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ছাত্রাবাসগুলোতে যেমন অধিক নিরাপত্তা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আর্থিক সাশ্রয়সহ অন্য সুযোগ-সুবিধাও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর মহানগরীতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি), মেডিক্যাল কলেজ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ, সরকারি বেগম রোকেয়া মহিলা কলেজ, সরকারি বাণিজ্যিক কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সরকারি রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, তাজহাট কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নামিদামি সরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারিভাবে গড়ে উঠেছে ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, প্রাইম মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ, নর্দার্ন মেডিক্যাল কলেজ, কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আরসিসিআই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে, কিন্তু আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র সাড়ে চার হাজারের মতো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নামমাত্র আবাসিক সুবিধা থাকলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা-ও নেই। অর্থাৎ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ আবাসিক সুবিধা থাকার কথা, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা নেই।
রংপুর ছাত্রকল্যাণ পরিষদ নামের একটি সংগঠনের পরিচালিত জরিপে জানা গেছে, রংপুরের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীর। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। মফস্বল থেকে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৫ হাজার শিক্ষার্থীকে থাকতে হচ্ছে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা মেস ও ভাড়া বাসায়, যেখানে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি গুনতে হচ্ছে বেশি টাকা।
রংপুর কারমাইকেল কলেজে প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রী। কলেজে যে তিনটি ছাত্রীনিবাস রয়েছে, তাতে আসনসংখ্যা মাত্র ৭০০। এ ছাড়া ছাত্রাবাস রয়েছে চারটি, যেখানে আসনসংখ্যা এক হাজার। কিন্তু সেগুলোও আট বছর ধরে বন্ধ। বেরোবিতে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার, কিন্তু আবাসনের ব্যবস্থা আছে মাত্র ২৫০ ছাত্রীর। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে দুই শিফট মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। আবাসনব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ৩০০ ছাত্র-ছাত্রীর। একই দশা রংপুর সরকারি কলেজের। সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে প্রায় চার হাজার ছাত্রীর জন্য মাত্র একটি ছাত্রীনিবাস রয়েছে, যেখানে সিট রয়েছে মাত্র ২৫০টি। ওই সব ছাত্রীর অর্ধেকেরই পড়াশোনা করছে রংপুর শহরের বাইরে থেকে এসে। বেরোবির বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট তাবিউর রহমান জানান, সেখানে ৩৪২টি আসনে গাদাগাদি করে চার শতাধিক শিক্ষার্থীকে স্থান দেয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে ‘সুযোগ’ হিসেবে কাজে লাগিয়ে রংপুর শহরে গড়ে উঠেছে বেসরকারি পর্যায়ে বহু ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস। এটিকে এখন লাভজনক একটি ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছে অনেকে। কারমাইকেল কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আশির দশকের শেষের দিকে রংপুর শহরে মেসগুলো গড়ে ওঠে। এর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে লালবাগ ও দর্শনা এলাকায়। সেখানে কেডিসি রোডে ছাত্রীনিবাস রয়েছে দুই শতাধিক। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মা ছাত্রীনিবাস, আঁখি ছাত্রীনিবাস, মনোয়ারা ছাত্রীনিবাস, নুরানী ছাত্রীনিবাস, আলহাজ নুরানী ছাত্রীনিবাস, নিউ নুরানী ছাত্রীনিবাস, জনতা ছাত্রীনিবাস, আইহিয়ান ছাত্রীনিবাস ও নোরিন ছাত্রীনিবাস। এসব ছাত্রীনিবাসে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা কোনোটাই নেই উল্লেখ করে ছাত্রীনিবাসের বাসিন্দা আকলিমা বেগম ও সোমা আক্তার জানান, ছাত্রীনিবাসে প্রতি আসনের ভাড়া দিতে হয় মাসে এক হাজার ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এখান থেকে প্রতিদিনই জামাকাপড় চুরি হয়।