শিক্ষা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। যে অধিকার অর্জনের মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। সমাজকে নিয়ে ভাবে। আর উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে মানুষকে বিশ্লেষণ করতে শেখে। কিন্তু একটা কথা প্রায়ই বলা হয় : শিক্ষার সংকট চলছে। প্রকৃতপক্ষে যেখানে শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও সীমারেখা টেনে ধরা হয়, সেখানেই শিক্ষার সংকট প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ সীমাবদ্ধতা শুধু শিক্ষার দীনতা প্রকাশ করে না, অনেক ক্ষেত্রে মনের দীনতাকেও প্রকাশ করে। যে শিক্ষা মানুষের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্যের ধারণা সৃষ্টি করে, ধর্ম-বর্ণের মধ্যে বিভাজন করতে শেখায় আর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টির ধারণা তৈরি করে না সেই শিক্ষা কখনও সফল হয় না। তাই শিক্ষাকে সাজাতে হয় তার সার্বজনীনতা ও বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃজনশীলতায়। আর এজন্য প্রয়োজন শিক্ষা নিয়ে গবেষণা। অন্যদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ দরকার। আবার শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগসূত্র তৈরি করতে না পারলে তা নিজেকে ও নিজের শেকড়কে চেনার, জানার ও চর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের সংকীর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে। একইভাবে শিক্ষার সঙ্গে ধর্মকে, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিকে যখন মতবিরোধের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় তখন শিক্ষা তার প্রকৃত স্বরূপ হারায়।
প্রত্যেক ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল মানবকল্যাণ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হল মানবকল্যাণ। কাজেই উদ্দেশ্য যেখানে সমান্তরাল সেখানে একটিকে অপরটির প্রতিবন্ধক হিসেবে কখনই বিবেচনা করা যায় না। শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে কিনা অথবা সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে কিনা, এটা বলা অসম্ভব। এ বিশ্বায়নের যুগে সমাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি মিশ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার জায়গা করে নিয়েছে এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ধারণা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে।
তবে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে অন্যের ইতিবাচক সংস্কৃতি গ্রহণ করার প্রবণতা শিক্ষার অগ্রসরমান চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে পারে। প্রায় শত বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দ সংস্কৃতি ও শিক্ষার মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের দর্শন তুলে ধরেছিলেন। যেখানে একটি অগ্রসরমান সংস্কৃতি আছে সেখানেই গৌরবান্বিত হওয়ার মতো শিক্ষা কাঠামো গড়ে উঠেছে। প্রাচীন ভারত একটি মহান সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে, কারণ এটি শিক্ষার একটি চমৎকার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সময়ের সঙ্গে শিক্ষা রূপান্তরিত হতে পারে আর অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার রূপান্তরণের বিষয়টি সাংস্কৃতিক ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, যদি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভাবধারায় শিক্ষার কাঠামো গড়ে ওঠে তবে কীভাবে একটি বিদ্যমান সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা ঘটে। প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতির রূপান্তর উন্নত, উদার ও কল্যাণমুখী শিক্ষার চর্চা ও তার বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-ভাবনা তার সময়কে অতিক্রম করে আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তির, ভাবনার সঙ্গে কর্মের, জ্ঞানের সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের, স্থানিকতার সঙ্গে বিশ্বায়নের, গ্রহণের সঙ্গে বিতরণের আর আনন্দের উপাত্ত হিসেবে শিক্ষা লাভের ও তার বিকাশের যে চিন্তা তিনি করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। আর এটি হল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের চিরায়ত রূপ।
মানুষের ভেতরের অন্তর্নিহিত শিক্ষার আস্বাদন নিংড়ে বের করার মধ্যেই শিক্ষার সাফল্য। সুইডেনের শিক্ষা পদ্ধতি মানুষের ভেতরে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে। নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে কীভাবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো সম্ভব তার সৃজনশীল ধারণা এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ফলে মানুষ শিক্ষা থেকে দূরে সরে না গিয়ে বরং শিক্ষাকে কাছে টেনে নেয়। প্রতিদিনের জীবনাচরণ, মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা, সহজ-সরল আনন্দপূর্ণ বিজ্ঞানচর্চা আর প্রকৃত মানুষ হওয়ার মানসিকতা তাদের শিক্ষাকে জীবনধর্মী করে তুলেছে- যেখানে আছে বাস্তবতা, নেই কোনো জটিল কল্পিত চিন্তাধারা, নেই কোনো তাত্ত্বিক পরীক্ষা, আছে নিজেকে মানুষ হিসেবে বড় ও উদার করে তোলার। শিক্ষায় কখনও শ্রেণীবৈষম্য থাকতে পারে না। শিক্ষার শ্রেণী বিভাজন সমাজ, শিক্ষা আর সংস্কৃতির মধ্যে বিভাজন তৈরি করে। কাজেই শিক্ষা হতে হবে সংস্কৃতিবান্ধব। বিজ্ঞানচর্চা, সমাজ, দর্শন আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠতে পারে। শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে পারে, তবে তা যেন কখনও মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
২.
কখন থেকে মানুষ ক্রিটিকাল এনালাইসিস শুরু করবে এ নিয়ে অনেকে বিতর্ক তুলতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তার মধ্যে ক্রিটিকাল এনালাইসিস শুরু হয়। সে একজন আপনজনকে অনুভব করতে শেখে। তার আবেগ, হাসি-কান্না আর অনুভূতিকে বুঝতে পারে। এক ধরনের অদৃশ্য বন্ধন গড়ে ওঠে। আর সেই অদৃশ্য বন্ধনের মানুষটি হচ্ছে তার মমতাময়ী মা। তবে এ বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয় একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই। যেমন মা যখন সন্তানের সঙ্গে কথা বলেন, যখন ঘুম পাড়ানি গান শোনান, শিশু যখন হাঁটি হাঁটি পা করে চলতে শুরু করে তখন থেকেই ক্রিটিকাল এনালাইসিসের প্রক্রিয়াটি আরও পূর্ণতা লাভ করে। কারণ একজন শিশু যখন কথা বলতে শুরু করে, আনন্দে নেচে ওঠে আর কারও সাহায্য ছাড়া হাঁটতে শুরু করে তখন বোঝা যায় শিশুটি প্রকৃতি, মানুষ আর তাদের জীবনাচরণকে বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে এ সক্ষমতা গড়ে তুলেছে। ফলে শিশুটির শেখার আগ্রহ বেড়ে যায়।
এটা তার শিক্ষার হাতেখড়ি বলা যায়। কিন্তু ভোগবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যখন সে পদার্পণ করে তখন তার ক্রিটিকাল এনালাইসিস করার যে সক্ষমতা গড়ে উঠেছিল তা রুদ্ধ হয়ে যায়, ফলে শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করার পরিবর্তে তার মধ্যে কৃত্রিম শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে। বইয়ের বোঝা তার মধ্যে জ্ঞান সৃষ্টির উপাদান হিসেবে কাজ না করে তা এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে। ফলে শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারায়। প্রশ্ন হতে পারে, তার মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে ক্রিটিকাল এনালাইসিস করার যে সক্ষমতা জন্মের আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, তা থেকে সে কেন বিচ্যুত হয়ে পড়ল? তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেটিও তো বেড়ে ওঠার কথা। প্রকৃতপক্ষে এমনটিই ঘটার কথা ছিল; কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় গলদের কারণে তা তার গতিপথ হারায়। এর পরিণতিতে শিক্ষিত হয়েও মানুষের মধ্যে স্বশিক্ষা থাকে না। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষাকে সহজ করে জীবনমুখী করে তোলা। এটি সম্ভব হলে ক্রিটিকাল এনালাইসিস তার বাড়ার সক্ষমতা বজায় রেখে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে স্বশিক্ষার শেকড় শক্ত করে ধরে রাখত। আর প্রকৃত শিক্ষার মূল্য এখানেই। শিক্ষাকে যদি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হতো, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত করা হতো, বিজ্ঞানকে যদি হাতেকলমে আনন্দ ও সৃষ্টির অনুসর্গ হিসেবে চিন্তা করা হতো, জীবন, মানুষ, বাস্তবতাকে চেনা ও জানার আগ্রহ সৃষ্টির প্রয়াস থাকত তবে ক্রিটিকাল এনালাইসিস করার সক্ষমতা বাড়তে থাকত। যা শিশুকে আনন্দপূর্ণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে একদিন পরিপূর্ণ একজন মানুষে পরিণত করত। হয়তো একদিন তেমনটিই ঘটবে। কারণ আমরা আশাবাদী আর হার না মানা এক বীর জাতি।
৩.
জসীমউদ্দীন বলতেন, বই হল এমন একটা জিনিস যা একজন মানুষকে অতীত বর্তমান ভব্যিষৎ যে কোনো কালেই নিয়ে যেতে পারে। যে দেশে কোনোদিনও যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, বইয়ের পাতার রথ মানুষকে সেদেশেও নিয়ে যেতে পারে। কথাটা মিথ্যা নয়। কারণ বই হল জীবন ও বিবেকের দর্পণ। ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থে ১৯২০-এর দশকের আফগানিস্তানের বর্ণনা করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার মধ্যে কাজ করেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ। অনেকেই বলেন, এ বইটি পড়ার সময় তাদের মনে হয়েছে তারা আফগানিস্তানের মরুময় পথঘাট, পাহাড়-পর্বত আর মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখছেন। বইয়ের অক্ষর যে জীবন্ত হতে পারে এটি তার উদাহরণ। আবার বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে অনেকের মনে হয়েছে, তারা যেন ইতিহাসকে দেখছেন খুব কাছ থেকে। তারা যেন ইতিহাসের সঙ্গে চলেছেন এক স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার তীব্র বাসনায়। এ ধরনের জীবন্ত বইগুলোর আদলে যদি পাঠ্যবইগুলো শিক্ষার প্রধান উপকরণ হিসেবে প্রচলিত থাকত তবে বইকে বোঝা না মনে করে মানুষ তার জীবন ও সৃজনশীলতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করত।
অনেক দেশে বইয়ের ওপর গবেষণা হয়ে থাকে। যেমন নিউজিল্যান্ডের হরাইজন রিসার্চ দ্বারা বইয়ের ওপর গবেষণা করা হয়। গবেষণায় মানুষের ভেতরের দৃষ্টিকে খুলে দেয়া ও বিকশিত করার কৌশল অনুসরণ করে বই লেখা যেতে পারে বলে মতামত প্রকাশ করা হয়। কথাসাহিত্যের মতো করে বইগুলো লেখা হলে তা জীবনসম্পৃক্ত হবে বলে এ গবেষণায় তুলে ধরা হয়। পিটার অ্যাটকিনস ক্লাসিক পাঠ্যবই লেখার মাধ্যমে সাফল্য লাভ করেন। তার ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বই মানুষকে আগ্রহী ও গবেষণামনস্ক করে তোলে। অ্যাটকিনস ব্যাখ্যা করেন কীভাবে পাঠ্যবইয়ে জীবনবোধ ও সহজ উপস্থাপন গবেষণাকে প্রভাবিত করে গবেষক তৈরি করতে পারে। বইকে মানুষের গ্রহণ উপযোগী করে লেখার পরিকল্পনা, কৌশল ও বিষয় নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশেও বইয়ের ওপর গবেষণার প্রয়োজন আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠ্যবইগুলোর দুর্দশা দেখে বলেছিলেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?’ তাই শিক্ষাকে আলোকিত করার মাধ্যমে সোনার মানুষ তৈরির জন্য বই নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর