প্রাণিজগতে মানুষ অনন্য। মানুষের এই অনন্যতার উৎস তাহার জ্ঞানপিপাসা। অজানাকে জানিবার চাহিদা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী হইতে আলাদা করিয়াছে। আর এই জ্ঞান মানুষ একসময় সংরক্ষণ করিয়াছে শিলালিপিতে, গ্রন্থে। কালক্রমে সেই গ্রন্থ নিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম সুমেরীয় শিলালিপির সংগ্রহশালা হইতে আজকের আধুনিক ডিজিটাল লাইব্রেরি—সকলেরই উদ্দেশ্য হইল জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিনিময়। পাঠাগারে মানবসভ্যতা তাহার হাজার বছরের অর্জিত শিক্ষাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সাজাইয়া রাখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলিয়াছেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’ পুস্তক একাধিক সময় কালকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে।’ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
পাঠাগারের এই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করিয়া ইংরেজ আমল দেশব্যাপী পাঠাগার গড়িয়া উঠিয়াছিল। দেশে এখন ১০০ থেকে ১৬৬ বছরের পুরাতন লাইব্রেরি আছে ৩৪টি। সেইগুলি গড়িয়া উঠিয়াছে ১৮৫১ হইতে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এভাবে জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা, পত্রিকা পড়া, সমাজসেবা ও সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসাবে সারাদেশেই গড়িয়া উঠিয়াছিল গণগ্রন্থাগারগুলি। তেমনি একটি পাঠাগার হইল পুরান ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজের ‘রামমোহন গণপাঠাগার’। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয় ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের নামানুসারে। পাঠাগারটিতে নানা দুর্লভ বইয়ের সম্ভার রহিয়াছে কিন্তু সেখানে পাঠক অপ্রতুল। একসময় এখানে নানা বয়সি পাঠক আসিলেও বর্তমানে পাঠকের অভাবে এটি বন্ধপ্রায়।
পাঠাগারটির এই অবস্থার পিছনে নানা কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, সারাদেশেই পাঠাগারগুলির অবস্থা একই রকম, সবখানেই পাঠকের অভাব। এর পিছনে সার্বিকভাবে পাঠাভ্যাস কমিয়া যাওয়াকেই দায়ী করিতে হয়। দ্বিতীয়ত, পাঠাগারে প্রযুক্তিনির্ভর ও নতুন বইয়ের সংযোজন না থাকায় পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা হারাইতেছে পাঠাগারগুলি। অনেক পাঠাগারেই বছর বছর নতুন বই সংগ্রহ করা হয় না। পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির সংযোগ সেখানে দেখিতে পাওয়া যায় না। ফলে এই পাঠাগারগুলি নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করিতে ব্যর্থ হইতেছে। এছাড়া গণগ্রন্থাগারগুলি পাঠক ধরিয়া রাখিতে না পারার আরেকটি কারণ হইতেছে সময়সূচি। গণগ্রন্থাগারগুলি খোলা থাকে সকাল ১০টা হইতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। চাকরিজীবীরা অবসর সময়টি লাইব্রেরিতে কাটাইতে চাহিলেও তা সম্ভব হয় না। লাইব্রেরিতে পাঠক সমাগমের জন্য খোলা রাখা উচিত বিকাল ৪টা হইতে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত।
একসময় শিক্ষিত-বিদ্বান ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকিত পাঠাগারগুলি। কোনো কোনো এলাকার পাঠাগারকে কেন্দ্র করিয়া হইয়াছে সাহিত্য আন্দোলন, সমাজ উন্নয়ন। কিন্তু এখন সময়মতো খোলা হয় না অনেক গ্রন্থাগার। নতুন বইয়ের জোগান নাই, নাই পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা আশা করি, পাঠাগারগুলির পরিবেশ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করা হইলে ঠিকই মানুষ বই ও পাঠাগারমুখী হইবে। এইজন্য সারাদেশে নূতন করিয়া পাঠাগার আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হইবে।