আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কী শিখল বা না শিখল, তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে একশ’ নম্বরের মধ্যে কত নম্বর পেল সেটি। বিষয়টি আমরা কালচারে পরিণত করে ফেলেছি, কারণ একজন শতকরা কত নম্বর পেল তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী পর্যায়ে ভর্তি, চাকরি, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি। বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, কাজেই শুধু শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর শিক্ষকদের এ নিয়ে দোষ দিলে হবে না। একটি বিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা নির্ভর করে ওই বিদ্যালয় থেকে কতটা জিপিএ-৫ পেয়েছে তার ওপর।
এ ধারাবাহিকতা চলছে উচ্চশিক্ষায়, চলছে গবেষণার ক্ষেত্রেও। এখন ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ পিএইচডি করছেন। কেন করছেন? কারণ পিএইচডির সার্টিফিকেট অর্জন করা। এটি করার জন্য মানুষ ব্যস্ত।
কারণ এ কাগজটি থাকলে তাকে সবক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, চাকরি পেলে বেতন বেশি দেয়া হয়। সামাজিক মর্যাদা তো আছেই। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সার্টিফিকেটধারীরা গবেষণার ধারেকাছেও যান না, দেশ-দশ কিংবা মানবকল্যাণ তো দূরের কথা, নিজের শিক্ষার্থীদের জন্যও এক বিন্দু গবেষণা তারা করেন না।
কাজেই শুধু সার্টিফিকেটধারীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তা একটি জটিল বিষয়। প্রকৃত পিএইচডি ডিগ্রিধারী আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু পিএইচডি মানে এখন অনেকের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে তা হল, বিভিন্ন জনের লেখা জোড়াতালি দিয়ে একটি পেপার বানানো এবং সেটি জমা দিয়ে একটি ডিগ্রি অর্জন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নীলক্ষেতে মিলছে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রতিবেদন। স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে নীলক্ষেত থেকে ওইসব গবেষণাপত্র সংগ্রহ করছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এর প্রধান ক্রেতা।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নয়, অনেক এমফিল ও পিএইচডি থিসিসও টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনেক সময় অন্যের থিসিস চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ইতিপূর্বে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি রয়েছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়।
গত কয়েক বছর ধরে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের বাংলাদেশি শাখা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। ঘরে বসে অনলাইনে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার ব্যবস্থাও অনেক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে।
ফলে টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া যাচ্ছে। তাই পিএইচডি ও সমমানের ডিগ্রি দেয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এক শিক্ষক ৯৮ শতাংশ হুবহু নকল পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের মাধ্যমে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন।
এ গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অভিযোগ করেছেন, একাধিকবার অনুরোধ করলেও ওই শিক্ষক থিসিসের কোনো কপি তাকে দেননি।
গবেষণা কেন করব- এ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরটা লুকিয়ে আছে। ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গবেষণা। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস একবার বলেছিলেন, ‘আপনি কখনই এক নদীতে দু’বার পা রাখতে পারবেন না। কেননা, দ্বিতীয়বার যখন পা রাখবেন, তখন নদীও খানিকটা পরিবর্তিত হয়েছে, সঙ্গে আপনিও।’
পরিবর্তন যেটুকু হল, সেটি ধরতে পারাটাই হচ্ছে গবেষণা। গবেষণা করতে গেলে কি বিরাট ডিগ্রিধারী হতে হবে? এখানে ধৈর্য একটি বিরাট বিষয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক, শিক্ষাগত ইত্যাদি যে কোনো সমস্যায় সমাধান খোঁজার জন্য প্রয়োজন গবেষণার।
সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে উঠতে পারে একজন গবেষকের মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘গবেষণা সম্পর্কে একটা ধারণা আছে যে, এটি নীরস, তথ্য বিশ্লেষণের ভারে ও রেফারেন্স-টীকা-টিপ্পনীতে ভারাক্রান্ত।
কিন্তু গবেষণার বিষয়বস্তু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারলে ও গবেষণার পদ্ধতি ঠিকঠাক নির্বাচন করা গেলে গবেষণা করা ও অভিসন্দর্ভ পাঠ করা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে।
গবেষণা প্রশ্নকে মাথায় রেখে তথ্য সংগ্রহের পরে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল উপস্থাপনের পুরো প্রক্রিয়াটিতেই আবিষ্কারের রোমাঞ্চ কাজ করে। তবে পূর্বশর্ত একটাই- গবেষককে খোদ গবেষণা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হবে।’
রাজনীতিদুষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায় ‘গবেষণার চেয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থান দেয়ায় দিন দিন সুনাম হারাতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও গবেষণার ক্ষেত্রে কম বরাদ্দ, গবেষণা কেন্দ্রগুলোর পরিচালকের দায়িত্ব রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে অর্পণ, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের মারপ্যাঁচে প্রকৃত গবেষকদের ডিগ্রি প্রদানে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।’
এটি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মতামত। এ ছাড়া এক সময় কারিকুলাম ও আধুনিক উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় মুগ্ধ হয়ে বহু দেশি-বিদেশি পণ্ডিত এ দেশে গবেষণা কাজে নিযুক্ত হলেও নানা কারণে বর্তমানে সে হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি, আমাদের কৃষিবিদরা যেসব গবেষণা করছেন; তার প্রত্যক্ষ ফল দেশ ও দেশবাসী ভোগ করছেন। তাদের বলার দরকার নেই যে, তারা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন কিংবা করেননি।
তাদের গবেষণার ফল ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র; ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে, শাকসবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে। বাকি গবেষকদের গবেষণার ফল আমরা প্রত্যক্ষ করছি না। তাদের গবেষণা শুধুই কাগজ-কলম আর সভা-সেমিনারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
শিক্ষাক্ষেত্রে কত শত ধরনের সমস্যা বিরাজ করছে অথচ সে ধরনের বাস্তব কোনো সমাধান কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ বিষয়ে গবেষণার অন্ত নেই, পিএইচডি ডিগ্রিধারী বাড়ছেই; কিন্তু শিক্ষার সমস্যাও ধাই ধাই করে বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ইন্সটিটিউট আছে। তাদের কোনো গবেষণাকর্ম কি আমাদের শিক্ষার কোনো কাজে কখনও আমরা দেখেছি? তারা একটি সমস্যা কেন হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ অনেক সময় করেন; কিন্তু কোনো সমাধানের মধ্যে তারা নেই। অনেক সময় দেখা যায়, এসব গবেষক প্রচুর রিকমেন্ডেশন দিয়ে থাকেন, যেগুলো বাস্তবসম্মত নয়।
আমাদের দেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে, শিক্ষার বাস্তবতা মাথায় নিয়ে যে সমাধান বের করা হবে, সেটি কাজে লাগবে। এটি বললে হবে না যে, একটি ক্লাসে বিশজনের বেশি শিক্ষার্থী থাকতে পারবে না, মাধ্যমিকের একজন শিক্ষককে মাস্টার্স পাস হতেই হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারা বিদেশে যাচ্ছেন, প্রচুর শিক্ষার্থী তৈরি করছেন; কিন্তু শিক্ষার সমস্যা সমাধানের কোনো পথ আমরা পাচ্ছি না। তাহলে এসব কাগুজে পিএইচডি দ্বারা দেশ কতটা উপকৃত হবে? একইভাবে আমরা প্রচুর ডাক্তার উৎপাদন করছি অথচ চিকিৎসার জন্য মানুষকে যেতে হয় ভারতে। ভারত কি উন্নত রাষ্ট্র? তাতো নয়।
সেখানকার ডাক্তাররা অধিকাংশই রোগীদের কথা শোনেন, তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেন, যত্নের সঙ্গে, সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের ডাক্তাররা (অধিকাংশই) আজ পর্যন্ত জানেনই না রোগীদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়।
৫ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গবেষণা সম্পর্কে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গবেষণা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে শুধু গবেষণা করলেই হবে না। গবেষণার জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তার ফলাফলটা কী সেটাও জানাতে হবে।
গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়ে দেশ ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই সে গবেষণা সার্থক। আমাদের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রেই গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছি, আর বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদের চলতে হবে। দেশের মানুষ যেন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, সেজন্য বিজ্ঞানমনস্কভাবেই তাদের আমরা গড়তে চাই।’
আসলে কোনো একটি বিষয় কী জন্য সংঘটিত হয়েছে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, এর পেছনের কারণগুলো কী, এটি কীভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, কোন কোন ধরনের মানুষের কল্যাণে কাজ করছে, কীভাবে এটিকে আরও ব্যাপক কল্যাণের কাজে ব্যবহার করা ইত্যাদির জন্যই কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণা প্রয়োজন।
সেটি নিজের, পরিবারের, প্রতিষ্ঠানের, দেশের এবং সার্বিকভাবে মানবকল্যাণে কতটা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সেজন্যই মূলত গবেষণা। জোড়াতালি দিয়ে, কে কী বলেছেন ইত্যাদি সংযোজন করে দিয়ে পিএইচডির একটি সনদ সংগ্রহ করলেই প্রকৃত গবেষক হওয়া যায় না। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক