বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত অধ্যাপক পদের অভিজ্ঞ শিক্ষকরা। অথচ দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই চলছে অধ্যাপকের তীব্র সংকট। যদিও দেশে শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়েই কর্মরত মোট অধ্যাপকের ৮০ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বমোট ১৭৩ শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ছিলেন মাত্র একজন। বর্তমানে ২৪টি বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন ১৮০ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র দুজন। অর্থাৎ দেড় বছরেও সংকটের চিত্র তেমন পাল্টায়নি। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বণিকবার্তা পত্রিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
একই অবস্থা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে ১৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে কোনো অধ্যাপকই ছিলেন না। সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ২১টি বিভাগে শিক্ষকসংখ্যা প্রায় ১৭৫। এর মধ্যে দুজন স্থায়ী অধ্যাপক ও একজন অস্থায়ী অধ্যাপক রয়েছেন।
ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের নতুন আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের তীব্র সংকট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভাগপ্রতি গড়ে একজন অধ্যাপকও নেই। এমনকি কোনো কোনোটিতে অনুষদপ্রতিও একজন অধ্যাপক নেই। এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিজ্ঞ শিক্ষক ছাড়া উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ঢাকা, বুয়েট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাস ছেড়ে শিক্ষকরা যেতে চান না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সংকটের কথা বলা হচ্ছে সবগুলোই ঢাকার বাইরের। শিক্ষকতার বাইরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া, পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান ঢাকার শিক্ষকরা। ঢাকার বাইরে এসব সুযোগ নেই। এ কারণে তারা ঢাকা ছাড়তে আগ্রহী হন না। যদিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক থাকা খুবই জরুরি। প্রভাষকরা মূলত এই জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ পান।
ইউজিসির তথ্য মতে, ২০১৭ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮০ শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক ছিলেন মাত্র তিনজন। সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২১টি বিভাগেই জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের তীব্র সংকট রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজন অধ্যাপক রয়েছেন। সম্প্রতি কয়েকজন শিক্ষককে অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পাওয়া যায় না। আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যায় না। শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এই হাল।
জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের রাজধানী ছাড়তে অনাগ্রহের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, এখন ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ-সুবিধা অনেক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। ঢাকার বাইরে যানজট, বায়ুদূষণ নেই। সব মিলিয়ে অনেক ভালো পরিবেশ।
ইউজিসির ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা হলো যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৯ শিক্ষকের মধ্যে চারজন অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২৩ জন শিক্ষকের মধ্যে আটজন অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪০ জন শিক্ষকের মধ্যে পাঁচজন অধ্যাপক এবং মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯০ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র সাতজন অধ্যাপক রয়েছেন বলে ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫ জন শিক্ষকের মধ্যে কোনো অধ্যাপক নেই।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট অধ্যাপক রয়েছেন ৩ হাজার ৯০৬ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ কৃষি এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েই (বুয়েট) কর্মরত ২ হাজার ২৭৭ জন। অর্থাৎ এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন মোট অধ্যাপকের ৫৮ শতাংশ। আর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন ৩ হাজার ১৪১ জন, যা মোট অধ্যাপকের ৮০ শতাংশ।