বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে এখন চলছে করোনার মহামারী। দুনিয়াজুড়ে এখন আক্রান্ত সাড়ে ৩৯ লাখের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে দুই লাখ ৭৫ হাজার। দেশেও ১৩ হাজার ৭৭০ জন আক্রান্তের পাশাপাশি এ পর্যন্ত ২১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ছোয়াচে এই রোগ প্রতিরোধে সঙ্গনিরোধ, লকডাউন, হাত ধোয়াসহ নানা রকমের পরামর্শ দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
রোগ থেকে নিরাপদ রাখতে বাংলাদেশসহ বিশে^র অন্যান্য দেশ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এতকিছুর মধ্যেও প্রশ্ন ওঠেছে মুদ্রা নোটের মাধ্যমে কি রোগটি ছড়াতে পারে ? রোববার (১০ মে) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়, প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাজন ভট্টাচার্য।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সঙ্গনিরোধ বা নিয়ম মেনে চলাফেরা করলেও হাটবাজার তো থেমে নেই। খোলা ব্যাংকিং কার্যক্রম। বাঁচার প্রয়োজনে আর্থিক লেনদেন না করেই বা উপায় কি। সত্যিই উপায় নেই। তাই টাকা বা ডলার এমনকি স্থানীয় মুদ্রা থেকে করোনা ছড়াতে পারে কিনা এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে দেশে দেশে। তবে সংবাদপত্রের কাগজ থেকে যে করোনা সংক্রমিত হয় না এই তথ্য অনেক আগেই প্রকাশ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
কিন্তু টাকা বা ডলার থেকে ছড়ানোর বিষয়টি এখনও সাধারণ মানুষের জানার বাইরে রয়ে গেছে। তবে করোনার আশঙ্কায় মুদ্রানোট ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে। তাই টাকা লেনদেনে সাবধান। প্রয়োজনে হ্যান্ড গ্ল্যাভস ব্যবহার করে লেনদেন করতে হবে। ব্যবহার শেষে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
ব্যাংক নোট বা টাকায় নানা ধরনের জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করার ঘটনা নতুন নয়। এমনকি ব্যাংক নোটের মাধ্যমে সংক্রামক নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথাও বলেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৫ সালে দিল্লীর ইনস্টিটিউট অব জিনোমিকস এ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজির বিজ্ঞানীরা তাদের এক গবেষণার ফলে জানান, ভারতের বাজারে চালু নোটগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে তাতে অন্তত ৭৮ রকম বিপজ্জনক মাইক্রোবের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন - যা থেকে মারাত্মক সব রোগ ছড়াতে পারে।
এমনকি বাংলাদেশের একদল গবেষক গত বছরের অগাস্ট মাসে বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশী কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রায় এমন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সাধারণত মলমূত্রের মধ্যে থাকে।
ভারতের পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাপা নোট বা ধাতব মুদ্রা নাড়াচাড়া করলে সরাসরি জীবাণুর সংস্পর্শে আসে হাতের আঙুল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভীতির মাঝে বিষয়টি চিন্তায় ফেলেছে অনেককেই। আশঙ্কার স্বপক্ষে প্রমাণও রয়েছে অজস্র্র্র।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে জোর দেয়া হচ্ছে নিয়মিত হাত ধোয়ার ওপরে। কিন্তু নিয়মিত ব্যবহার্য যে সমস্ত জিনিস আমরা স্পর্শ করি, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নয়। এমনই এক নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী টাকার নোট, যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে ভয়াবহ ভাইরাস সংক্রমণ।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছিল যে, ভারতে মহারাষ্ট্রের বুলদানার একাধিক প্রান্ত থেকে সংগৃহীত ১০০, ৫০, ২০ ও ১০ টাকার প্রতিটি নোটে কলেরা ও টাইফয়েডের জীবাণু পাওয়া গেছে।
অন্য একটি গবেষণায় বিভিন্ন অঙ্কের ৯৬টি নোট এবং ৪৮টি কয়েন পরীক্ষা করে তাদের মধ্যে নানান রোগের উৎস একাধিক প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ও পরজীবীর সন্ধান মিলেছে। ২০১৫ সালে এই গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। গবেষণা পরিচালনা করে লখনউয়ের কিং জর্জেস মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি ও পালমোনারি মেডিসিন বিভাগ।
শুধু ভারতেই নয়, আমেরিকার ডলার নোটে ৩ হাজার প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া খুঁজে পেয়েছিলেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। এই গবেষণা ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ হয়।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভীতি ছড়ানোর জেরে কয়েকদিন আগে এশিয়া থেকে ঘুরে আসা ডলার নোট কোয়ারেন্টাইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে আমেরিকার ফেডেরাল রিজার্ভ। রয়টার্স জানিয়েছে, আমেরিকায় ফের ওই নোট চালু করার আগে সেগুলোকে যথাযথ পদ্ধতিতে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে।
টাকা লেনদেনের সময় এক ব্যক্তির টাকা অপর ব্যক্তির হাতে যাওয়ার সময় করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এই কারণে নগদ লেনদেন এড়িয়ে এটিএম কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
গত দুই মার্চ এক বিবৃতিতে ডব্লিউএইচও জানায়, টাকা দিয়ে লেনদেন করার পর ভালভাবে হাত ধোয়া উচিত। নতুবা হাতে লেগে থাকা জীবাণু আরেক ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
এরই মধ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তাদের গ্রাহকদের নগদ টাকা ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়েছে। নগদ টাকায় ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস লেগে থাকতে পারে বলে সতর্ক করেছে ব্যাংকটি। এই কারণে গেল মাস থেকে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের নগদ লেনদেন করতে জনগণকে নিরুৎসাহিত করছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্রী নিশাত তাসনিম প্রায় ছয় মাস ধরে বাজারে প্রচলিত টাকা ও কয়েন নিয়ে গবেষণা করে বলেন, এসব মুদ্রায় তিনি ই-কোলাই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন।
১৫টি উৎস থেকে নেয়া কাগজের টাকার নোট ও কয়েনে এক হাজারের চেয়ে আরও অনেক বেশি মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখেছেন তারা। এক হাজার মাত্রা পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়াকে সহনশীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী টাকা নিয়ে করা ওই গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। এর আগে তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, এ পরীক্ষায় আমরা যা পেয়েছি তা জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ভয়াবহ। কারণ সাধারণ ব্যাকটেরিয়া তো আছেই, সঙ্গে পাওয়া গেছে মানুষের মলমূত্র থেকে আসা ব্যাকটেরিয়া, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক’।
ফলে এসব মুদ্রার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা গবেষণা করে টাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি যা মানুষের অন্ত্রে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে তাই এর মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাছাড়া টাকা বা ডলারের ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাস শুধু একটি দেশের মধ্যে নয় বরং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
যেহেতু এটা সরাসরি মানুষ হাত দিয়ে ধরে, অনেক সময় মুখের থুথু নিয়ে কাউন্ট করে। তাই এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানো অসম্ভব কিছু নয়। সেখান থেকে এটা হতে পারে যদি মানুষ সে হাতে খায়, মুখে দেয়।
ভাইরাস বাহকের শরীরে সক্রিয় হয়, অন্যত্র নিষ্ক্রিয় থাকে। টাকায় থাকলে সে হয়ত নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে এলে সেটি করোনাভাইরাসের উপসর্গ বা রোগের সৃষ্টি করতে পারে, এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
জাতীয় রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, ভাইরাসটি যাতে অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ব্যাংক নোট ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।