সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নীলক্ষেতে মিলছে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা প্রতিবেদন। স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে নীলক্ষেত থেকে ওইসব গবেষণাপত্র সংগ্রহ করছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এর প্রধান ক্রেতা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নয়; অনেক এমফিল ও পিএইচডি থিসিসও টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় অন্যের থিসিস চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ইতিপূর্বে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধেও ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বুধবার (২২ জানুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পিএইচডি ডিগ্রি জালিয়াতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে ওই শিক্ষকের ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি রয়েছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। গত কয়েক বছর ধরে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের বাংলাদেশি শাখা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। ঘরে বসে অনলাইনে বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার ব্যবস্থাও অনেক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। ফলে টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া যাচ্ছে।
আর এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের যথাযথ নজরদারির অভাবে এমনটি বেশি ঘটছে, তা হলফ জোর দিয়ে বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তারা এমন অপকর্ম করছে। এমনিতে এ দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের বাংলাদেশি শাখা টাকার বিনিময়ে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর, এমবিএ, এলএলবি প্রভৃতি বিষয়ের সনদ প্রদানের মাধ্যমে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিম্নে নিয়ে গেছে।
তার ওপর যদি ওইসব প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা শুরু করে; তবে অচিরেই এ দেশের ঘরে ঘরে ডক্টরেটের অভাব হবে না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়ার মতো প্রতি বছরই কয়েক লাখ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি পাবে বাংলাদেশ। তাই শুধু ডিগ্রি অর্জন করলেই হবে না, মানসম্মত পিএইচডি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও গবেষণার ক্ষেত্রে এ দেশের কৃতি সন্তানদের ঐতিহ্য বেশ অহংকার করার মতো। এ দেশের বহু কৃতি সন্তান উন্নত বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। ‘ঈশ্বর কণা’র জনক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, গাছেরও প্রাণ আছে তত্ত্বের জনক জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো ক্ষণজন্মা গবেষকদের সংখ্যা কম হলেও পাটের জিনম আবিষ্কারক বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের মতো গবেষকরা এ দেশের মানুষের মেধা-গবেষণাকে বিশ্বের দরবারে বহুবার নতুনভাবে পরিচিত করিয়েছেন।
তাই বাংলাদেশের উচ্চতর গবেষণার মান যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে অথবা টাকার বিনিময়ে সনদপ্রাপ্তির ঘটনা বারবার ঘটতে থাকলে বাংলাদেশের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের উন্নত বিশ্বে সুযোগ পাওয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তখন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের মতো দু-একজন গবেষকের সাফল্য দিয়ে ওই দুর্বলতা আড়াল করা কঠিন হবে।
টাকার বিনিময়ে এমফিল ও পিএইচডি অভিসন্দর্ভ, গবেষণা প্রবন্ধ, এমএ শ্রেণির মাঠকর্ম প্রতিবেদন ও অভিসন্দর্ভ লিখিয়ে নেয়ার যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে তা সত্য।
এমনকি টাকা খরচ করলে এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তরের সনদের মতো এমফিল ও পিএইচডির সনদও পাওয়া কঠিন নয়। ফলে এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা এখন আর গবেষণা করতে একদমই ইচ্ছুক নয়।
মাস্টার্স শ্রেণির থিসিস সুপারভিশন করতে গিয়ে দেখেছি- প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী ইতোপূর্বে গবেষণা হয়েছে এমন বিষয় নিয়েই কাজ করতে বেশি আগ্রহী। তাদের এমন চাওয়ার কারণ হচ্ছে- ওই বিষয়গুলোর ওপর অনেক কাজ থাকায় তারা গরু খোঁজা ছাড়াই অর্থাৎ কঠিন পরিশ্রম ছাড়াই থিসিস লেখা শেষ করতে পারবে।
এ ক্ষেত্রে বড় ভাই বা বোনরাই তাদের মূল ভরসা। শিক্ষকের চোখকে ফাঁকি দিতে পূর্বসূরিদের থিসিসের প্রথম ও শেষের কিছু বিষয় পরিবর্তন করলেই হল। কোনো শিক্ষকের পক্ষেই এ পর্যন্ত কত বিষয়ের ওপর কাজ হয়েছে এবং ওইসব থিসিসের লাইন বাই লাইন মনে রাখা সম্ভব নয়, বিষয়টি তাদের ভালো করেই জানা। ফলে একটু কৌশল অবলম্বন করেই তারা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, পূর্বসূরিদের থিসিসটা একটু ওলটপালট ও কিছু সংযোজন-বিযোজনের মধ্যেই তাদের গবেষণা সীমাবদ্ধ থাকছে।
এ ক্ষেত্রে নীলক্ষেত তাদের অন্য একটি ভরসার জায়গা। যে বিষয়ই থিসিসের জন্য দেয়া হোক না কেন, টাকা হলেই তা অতি সহজে নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে নীলক্ষেত থেকে থিসিস সংগ্রহ করার ফলে দু’জন শিক্ষার্থীর মধ্যে থিসিস মিলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এমএ শ্রেণির থিসিস সুপারভিশন করতে গিয়ে এমন দু’জন শিক্ষার্থীকে পেয়েছি, যাদের থিসিসের ভূমিকা থেকে উপসংহারের প্রতিটি লাইন শুধু এক নয়; দাঁড়ি কমা পর্যন্ত মিলে গেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলও একই। এমনকি প্রথম জনের থিসিসের যে বানানগুলো ভুল, দ্বিতীয়জনেরও সে বানানগুলো ভুল। খোঁজ নেয়ার পর জানা গেছে, তারা দু’জনের কেউই থিসিসটি লেখেনি। অন্য কারোর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে।
তারা গবেষণার প্রতি এতটা উদাসীন যে, বানানগুলোও ঠিক করার প্রয়োজন মনে করেনি। শিক্ষার্থীর মতো শিক্ষকও উদাসীন হলেই এমন অপকর্ম করে পার পাওয়াটা সহজ। আর শিক্ষার্থীরা যদি টাকার বিনিময়ে থিসিস কিনে মাস্টার্স পাস করে যায়; তবে ভবিষ্যতে তারা উচ্চতর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির ক্ষেত্রে একই কৌশল অবলম্বন করবে, তা হলফ করেই বলা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এক সময় বিশ্বমানের গবেষণা হতো। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দেশে-বিদেশে গবেষণায় সাফল্য অর্জন করে বহুবার সেই কথার প্রমাণ রেখেছেন। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে এ দেশের গবেষণার মান কমতে শুরু করে।
গবেষণার চেয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিকে শিক্ষকরা ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ায় দিন দিন সুনাম হারাতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও গবেষণার ক্ষেত্রে কম বরাদ্দ, গবেষণা কেন্দ্রগুলোর পরিচালকের দায়িত্ব রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে অর্পণ, দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের গ্রুপিং গ্রুপিং খেলার ম্যারপ্যাঁচে প্রকৃত গবেষকদের ডিগ্রি প্রদানে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এক সময় কারিকুলাম ও আধুনিক-উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় মুগ্ধ হয়ে বহু দেশি-বিদেশি পণ্ডিত এ দেশে গবেষণা কাজে নিযুক্ত হলেও নানা কারণে বর্তমানে সে হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
এখন বিদেশি পণ্ডিতরা তো আসছেন না। বরং গবেষকদের চেয়ে শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরা অধিক মূল্যায়িত হওয়ায় অনেক গবেষকই বিদেশে পাড়ি জামাচ্ছেন অথবা গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন।
তাই এ দেশের গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ, উন্নত ল্যাব ও গবেষণা যন্ত্রপাতি, গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপশি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত (গবেষক, তত্ত্বাবধায়ক, পরীক্ষক, রিউভিয়ার, সম্পাদক প্রমুখ) ব্যক্তির মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
লেখক: মো. আবুসালেহ সেকেন্দার, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।