দেশের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতে উপাচার্য, ৭০টিতে উপউপাচার্য এবং ৫০টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই। উপাচার্য যেখানে আছেন, তাঁদের অনেকেই নামকাওয়াস্তে। ট্রাস্টি বোর্ডই সব। সব কলকাঠি নাড়েন বোর্ডের সদস্যরা। তাঁদের কথার বাইরে গেলেই অনেক সময় চাকরি চলে যাচ্ছে উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষদের। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদগুলো এমন নড়বড়ে করে ফেলা হয়েছে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়া প্রথিতযশা শিক্ষকরা চাকরি শেষে বরং অবসর সময় কাটাচ্ছেন, কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা ৯৪টিতে উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদ থাকা উচিত। গত ২৮ আগস্ট ইউজিসি প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকায় দেখা যায়, ২৩টি প্রতিষ্ঠান উপাচার্য ছাড়া চলছে। উপউপাচার্য নেই ৭০টিতে, ৫০টি কোষাধ্যক্ষহীন; যদিও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পদে নিয়োগপ্রক্রিয়া চলমান বলে জানা যায়।
জানা যায়, এসবের বেশির ভাগই চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব পদে নিয়োগ দিতেই আগ্রহী নয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষে সনদও ইস্যু করছেন ভারপ্রাপ্তরা। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের যোগ্যতার ভুল তথ্য দিয়ে প্রস্তাবিত তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জেনেশুনেই উপাচার্যের জন্য এমন সব নাম পাঠায় যে তাতে দেরি হয়। একজন উপাচার্য, উপউপাচার্যের জন্য কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন তা তাদের জানা। এমনকি তিনজনেরই সব ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে। কিন্তু অনেকে ইচ্ছা করেই যোগ্যতার ঘাটতি রেখে নামের তালিকা পাঠায়। তাদের চিন্তা থাকে যত দিন দেরি করা যায়। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত করার প্রক্রিয়া ইন প্রসেসে আছে। এই প্রসেসেও অনেক সময় দেরি হয়।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী ও একাডেমিক কর্মকর্তা হবেন। তিনি সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকবেন। এ ছাড়া সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিলসহ বিভিন্ন কমিটির প্রধানের দায়িত্বেও থাকবেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, শিক্ষকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ কমিটির সভাপতিও হবেন উপাচার্য।
আইনে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সরঞ্জাম অনুমোদন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, সিন্ডিকেটের সুপারিশক্রমে পদ সৃষ্টি, নিয়োগসংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন, শিক্ষার্থী ফি নির্ধারণ, সিন্ডিকেট কর্তৃক সুপারিশকৃত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট অনুমোদন ইত্যাদি। সিন্ডিকেটের সুপারিশে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা বিভিন্ন বিষয়ের অনুমোদন দেবেন, তবে সিন্ডিকেটের প্রধান থাকবেন উপাচার্যই। অথচ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা নথিপত্র তৈরি করে দিচ্ছেন, উপাচার্যরা শুধু স্বাক্ষর করেন। কোনো ধরনের আর্থিক কার্যক্রমে উপাচার্যদের ভূমিকা নেই। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক হলেও সেটা এখন পুরোপুরি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। আর এই আর্থিক বিষয়ের পুরো দায়িত্বেই থাকেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা। এমনকি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যদের কক্ষ থেকে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যদের কক্ষ অনেক উন্নত মানের।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ উপাচার্যই তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ট্রাস্টি বোর্ডের ব্যাপক প্রভাব থাকে। তাদের বাইরে গিয়ে উপাচার্যদের কিছুই করার থাকে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী উপাচার্যের ক্ষমতা প্রয়োগ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয় বলে আমার মনে হয়। এ জন্য প্রথিতযশা শিক্ষকরা উপাচার্য হয়ে বিবাদে জড়াতে চান না।’
সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক মনে করেন। তাঁদের অর্থবিত্তের মোহ অনেক বেশি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়েও স্বচ্ছতা নেই। তাঁরা মন্ত্রণালয়কেও প্রভাবিত করেন।’
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাই তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। আবার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেই।’
বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রয়েছে বোর্ড অব ট্রাস্টি, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটি। আইনে এসব কমিটির সভা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। ২০১৭ সালে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো সভা হয়নি। ১১টিতে সিন্ডিকেট সভা, আটটিতে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা এবং ১৩টিতে অর্থ কমিটির সভা হয়নি।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের নামমাত্র ভূমিকা থাকায় তাঁদের আয়-ব্যয়ও স্বচ্ছ নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আয়-ব্যয় সমান। অনেক শিক্ষার্থী থাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি দেখানো হয়েছে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক প্রতিবেদনে। আয়-ব্যয় কিভাবে সমানে সমান হয় তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা যায়, রাজধানীর একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে প্রায় ২০ বছর ধরে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র একজন উপাচার্য তাঁর নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের কথা না শোনায় উপউপাচার্যকেও কিছুদিন আগে চাকরি হারাতে হয়েছে। রাজধানীর উত্তরার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কিছু ক্লাস নেওয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্বই দেওয়া হয়নি। এই অবস্থায়ই ওই শিক্ষক দুই বছর পার করছেন। বাকি সময়টা কিভাবে পার করবেন সেটা নিয়ে তিনি ভাবছেন। বনানীতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এমন এক উপাচার্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আবার রাজধানীতেই বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনে দুই দফা দায়িত্ব পালনের পরও কেউ কেউ ভারপ্রাপ্ত পদসহ ১৫ থেকে ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বড় বড় পদে বসিয়ে নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত দুটি, ধানমণ্ডিতে অবস্থিত দুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে সবাই চেয়ারম্যান হওয়ার কথা থাকলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে একজনই বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান। আর বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যই তাঁর পরিবারের। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের বড় অংশ বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে নিজেদের পকেটে ঢোকাচ্ছেন।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করলেও এখনো তাদের শিক্ষক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন একেক রকম। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতনে লেকচারার নিয়োগ দেওয়া হয় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ নানা প্রয়োজনীয় ছুটিও শিক্ষকদের দেওয়া হয় না। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছর চাকরি করার পরও মাতৃত্বকালীন ছুটি পাননি একজন শিক্ষক। তাঁকে বিনা বেতনে ছুটি নিতে হয়েছে। বড় অঙ্কের টাকা আয় করলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত বেতনও দেয় না শিক্ষকদের। আর শিক্ষক নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের সুপারিশ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোগ্য শিক্ষকও পাচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে গিয়ে ভালোভাবে শিখতে পারছে না।
গবেষণাকেই বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা নিয়েই প্রচণ্ড অনীহা রয়েছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ৯৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণা খাতে ২২টি কোনো বরাদ্দই রাখেনি। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট ব্যয় ছিল ৭৮ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটির গবেষণায় গড় ব্যয় ছিল প্রায় এক কোটি টাকা।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্রতিটি পদের জন্য তিনটি নাম পাঠাতে হয়। আর তাঁদের সবার সমান দক্ষতা থাকতে হয়। কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন তিনটি নাম পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কোনো কারণে যদি আবার তা রিজেক্ট হয় তাহলে আবার নতুন তিনজনকে খুঁজতে হয়। আমাদের দাবি, যোগ্যতাসম্পন্ন একজনের নাম প্রস্তাব করা। যদি অ্যালাউ না হয় তাহলে আরেকজনের নাম পাঠাব।’ ট্রাস্টি বোর্ডের ভূমিকার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘খুব কম বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের ট্রাস্টি বোর্ড উপাচার্যের কাজে হস্তক্ষেপ করে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের টাকা দিয়ে চালাতে হয় তাঁদের তো কিছু ব্যাপার দেখতেই হয়। আর যাঁরা উপাচার্য হন তাঁদেরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মনে করতে হবে। সেটা না করলেই ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে বিভেদ তৈরি হয়।’
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ