রোববার প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং হল সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা আমাদের যেমন হতাশ, তেমনই বিস্মিত করেছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, হল সংসদগুলোতে অন্তত ৫৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আর কোনো প্রার্থী নেই। এই পরিস্থিতিতে হতাশার বিশেষ কারণ ডাকসুর গৌরবময় অতীত।
এই ছাত্র সংসদ ক্যাম্পাসের বাইরেও জাতীয় রাজনীতিতে কী ভূমিকা রেখে এসেছে, গত তিন দশকের নির্বাচনহীনতার আগে আমরা দেখেছি। জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিক তৈরির 'সূতিকাগার' হিসেবেই কেবল নয়; জাতীয় রাজনীতির রসদও জুগিয়েছে ডাকসু। আমরা দেখেছি, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকেছে এখানকার ছাত্র সংসদও। ডাকসু যদিও ক্রিয়াশীল ছিল না, কথিত ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী আধা-সামরিক সরকারের বিদায় ঘণ্টা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই বেজে উঠেছিল। বস্তুত জাতীয় রাজনীতির গুণগত মান নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই অনুভূত হচ্ছিল ডাকসুর অনুপস্থিতিও।
প্রায় তিন দশকের স্থবিরতাকালে নানা মহল থেকেই দাবি উঠেছিল ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও আমরা একাধিকবার তুলেছি অভিন্ন দাবি। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে এই প্রত্যাশা অমূলক ছিল না যে, ডাকসু থেকেই শিক্ষা নেবে জাতীয় রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে আজকের ছাত্র নেতৃত্ব। কিন্তু চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ আমাদের মধ্যে যেন ভূতের পা দেখার মতো বিস্ময় জন্ম দিয়েছে। কথিত আছে, ভূতের পা থাকে পেছনের দিকে। ডাকসু নির্বাচন যেখানে জাতীয় রাজনীতিকে পথ দেখাতে পারত, সেখানে জাতীয় রাজনীতিরই ছায়াপাত ঘটছে ডাকসুতে। আমাদের মনে আছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেশ কিছু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আরও কিছু উপনির্বাচনে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা গেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতারই পুনরাবৃত্তি।
একই অঘটন দেখা যাচ্ছে চলতি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। এখন যদি ডাকসুতেও একই ধারা দৃশ্যমান হয়, তাহলে হতাশ না হয়ে উপায় কী? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া বেআইনি নয়, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের মর্ম ও গণতন্ত্রে সৌন্দর্য নিশ্চয়ই আহত হয়। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের দাপট অজানা নয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাওয়া ৫৬ জনের অধিকাংশই সেই দলের। হল সংসদের সদস্য পদে দুই-একজন প্রার্থীর বিপরীতে কোনো প্রার্থী না পাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বলে অর্ধশতাধিক! আমরা দেখেছি, ইতিমধ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, চাপে পড়ে তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা দেখতে চাইব, বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছে। প্রার্থিতাই যদি অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়, তাহলে সাধারণ ভোটাররা কতটা মুক্তহস্তে ভোট দিতে পারবে? ডাকসুতে আমরা ভোট উৎসব চাই, ভূতের পা দেখতে চাই না।
সৌজন্যে: সমকাল