আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রধান ও অন্যান্য রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী আচরণবিধির খসড়া প্রণয়নসহ বিভিন্ন কাজ শেষ হয়েছে। ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন কারা এ নিয়ে ছাত্র সংগঠনের ভেতরেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মিত ছাত্র, সাধারণ ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় এমন নেতাদেরই প্রার্থী করার কথা ভাবছেন তারা। অন্যদিকে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য ঢাবির ৩৬ হাজার শিক্ষার্থীর চাওয়া যিনি বুঝতে পারবেন, দাবি পূরণে উদ্যোগী- এমন প্রার্থীদেরই সমর্থন দেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিয়মিত শিক্ষার্থীর শর্ত পূরণ করতে না পারায় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং বাম সংগঠনের অনেক শীর্ষ নেতাই প্রার্থী হতে পারবেন না। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার শীর্ষ চার নেতার মধ্যে তিনজন; ছাত্রদলের চারজন; প্রগতিশীল ছাত্রজোটভুক্ত চারটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদভুক্ত তিনটি ছাত্র সংগঠনের ১০ জন- সব মিলিয়ে ৯টি সংগঠনের ১৭ নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
ছাত্রলীগের প্যানেলে প্রার্থী হতে পারেন যারা: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তিন শীর্ষ নেতা নিয়মিত ছাত্র না হওয়ায় বর্তমান গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ২০০৮-০৯ এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের। সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন ভর্তি হন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। গঠনতন্ত্র অনুসারে, শুধু সাদ্দাম হোসাইনই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-কৃষিশিক্ষা বিষয় সম্পাদক আসিফ উদ্দিন আহমেদ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন।
ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হচ্ছে, তাই একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রার্থী হওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। তাদের সেই সুযোগ পাওয়া উচিত বলে মনে করি। তবে সবাই যেভাবে নির্বাচন করবেন, আমরা সেভাবেই প্রার্থী ঠিক করব। আমরা গঠনতন্ত্রের বাইরে যাব না।
জাসদ ছাত্রলীগ : এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু'জনই ঢাকা কলেজের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাসুদ আহমেদ ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে ও সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পাল ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা কেউই প্রার্থী হতে পারবেন না। জাসদ (আম্বিয়া) সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঢাবির শিক্ষার্থী নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদেকুুর রহমান সাগর ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান রাহাত ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তারা প্রার্থী হতে পারবেন। ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক রুদ্র রফিকুল্লাহ রাব্বী ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ও যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাসেল ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তারা দু'জনই ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন।
ছাত্রদল প্যানেল: ছাত্রত্ব না থাকায় ছাত্রদলের শীর্ষ চার নেতার কেউই ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। ফলে তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এ ছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন হল শাখার নেতাদেরও ছাত্রত্ব নেই। প্রতিটি হলে সংগঠনটির পনেরো থেকে ত্রিশজনের আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে।
ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার বলেন, দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের বাধার কারণে অনেক নেতাকর্মীর শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়েছে। তাদের দলের অনেকেই নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রার্থিতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বাইরেও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইদুর রহমান রাফসান, সূর্য সেন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহফুজ চৌধুরী, তৌহিদুল ইসলাম তৌহিদ, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নুরে আলম ভূঁইয়া ইমন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য বোরহান উদ্দীন নয়ন, জিয়া হল ছাত্রদলের সদস্য মো. ইমন প্রমুখ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ : গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন শুরু করার দিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে ৪০ জনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আন্দোলনকে ঘিরে আটজন যুগ্ম আহ্বায়কসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হলে পরে তাদের অনেকেই নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এখনও ৩৬ জন সক্রিয় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৮ জনের ঢাবির ছাত্রত্ব রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর, রাশেদ খান, ফারুক হাসান- এই তিনজনের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বাদ পড়তে পারেন। এ ছাড়াও পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজ খান, বেলাল, সোহরাব হোসেন, বিন ইয়ামিন মোল্লা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন।
প্রগতিশীল ছাত্রজোট : ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি জি এম জিলানী ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না। ছাত্রত্ব না থাকায় বাদ পড়বেন সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী। সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আর সাধারণ সম্পাদক রাজীব দাস ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বিদ্যমান গঠনতন্ত্র অনুসারে, এ দুই নেতা ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আলমগীর হোসেন সুজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছেন। সাধারণ সম্পাদক রাজীব গান্ধী রায় ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বাসদ (মার্ক্সবাদী) সমর্থিত ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাসুদ রানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সাধারণ সম্পাদক রাশেদ শাহরিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী এবং সাধারণ সম্পাদক প্রগতি বর্মণ তমা দু'জনই ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে সালমানেরই কেবল ছাত্রত্ব রয়েছে।
ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কেউই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীর ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল হক ইশতিয়াক ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। এ ক্ষেত্রে ইশতিয়াকই কেবল প্রার্থী হতে পারবেন।
বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র গণমঞ্চ, ছাত্র সমিতি, ছাত্র ফোরামসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যোগাযোগ করছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বেশিরভাগ নেতাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মতামত ও গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য গঠিত কমিটির সুপারিশ নেওয়া হয়েছে। এবার ভোটার ও প্রার্থিতার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যারা ভোটার হতে পারবেন, তারা প্রার্থীও হতে পারবেন বলে মোটামুটি সবাই একমত হয়েছি।