ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে শিক্ষকেরা জড়সড় অনলাইন পাঠদানে - দৈনিকশিক্ষা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ে শিক্ষকেরা জড়সড় অনলাইন পাঠদানে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আগে থেকে অনলাইন ক্লাস চালু রাখলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাম্প্রতিক সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে। আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাস্তবতা জানি। অনেকেরই স্মার্টফোন নেই, ডেটা কেনার টাকা নেই, এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না, নেটওয়ার্কের অবস্থাও খুব বেশি ভালো না ইত্যাদি। সেই বাস্তবতা সঙ্গে নিয়েই এবং কীভাবে এসবের ন্যূনতমভাবে সমাধান করা যায়, সেটি মাথায় রেখে আমরা অনেকেই অনলাইন ক্লাস শুরু করেছি। শিক্ষার্থীরা অনেকেই ছাদে গিয়ে, গাছে উঠে, হাওর-বাঁওড় ঘেঁষে, পাহাড় ঘেঁষে কিংবা হাটবাজারে গিয়ে অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন। কেউ কেউ যুক্তি দেখাচ্ছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হয়েছে করোনার ভয়ে, কিন্তু এখন ক্লাসের জন্যও তো তাঁদের হাটবাজারে যেতে হচ্ছে, সেখান থেকে কি তাঁদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছে না? যাঁরা যোগ দিতে পারছেন, তাঁদেরও বিবিধ সমস্যা। ক্লাসেও শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবাই কমবেশি অফলাইন-অনলাইন হচ্ছেন। কিছু কথা শোনা যায়, কিছু যায় না। সোমবার (২০ জুলাই) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, আমরা ধরেই নিচ্ছি এই অনলাইন ক্লাসের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের মনোবল ধরে রাখা এবং কিছুটা পড়াশোনার সঙ্গে থাকা। তবে মনে রাখতে হবে যে অতি সত্বর যদি আমরা সব শিক্ষার্থীকে সমভাবে অনলাইনে না আনতে পারি এবং শুধু যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের নিয়েই ক্লাস চালিয়ে যাই, সেটি শিক্ষায় চলমান অসমতাকে আরও প্রকট করবে। এর পাশাপাশি এটি অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের মনে একধরনের হতাশা তৈরি করবে। এমন চলতে থাকলে তাঁরা যে পিছিয়ে পড়বেন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই বিষয়ে অনেক লেখালেখির পরও এখন পর্যন্ত ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের ফ্রি ডেটা ব্যবহারের বেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো ধরনের তৎপরতা দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমাধান না বাতলে দিলেও শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ করছেন কোর্স–সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে। যাঁরা অনলাইনে আসতে পারছেন না, ক্লাস লেকচারটি ক্যামেরায় ধারণ করে আপলোড করতে তাঁরা শিক্ষকদের অনুরোধ করছেন। তাঁরা যেন তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী পরে শুনতে পারেন।

আরও পড়ুন : ফেসবুক, ইউটিউবে ক্লাসের ভিডিও দিতে আপত্তি শিক্ষকদের

এটা তো গেল শিক্ষার্থীদের অনেকের সমস্যা। কিন্তু শিক্ষকদের অনেকে বলছেন অন্য ভয়ের কথা। বিশেষ করে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকেরা বিভিন্ন আলোচনায়, অনলাইন সভায় এই আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীন ও মুক্তভাবে মত প্রকাশ করে লেকচার দিতে পারবেন কি না, সে বিষয়টি নিয়েও তাঁরা চিন্তিত। এই আতঙ্ক আরও বেড়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অহরহ অপপ্রয়োগের কারণে। উদ্বেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন, লেকচারটি হয়তো ফেসবুকে ভাইরাল করে মামলা দেওয়া হবে। চলবে নানা ধরনের রাজনীতি। এখন প্রশ্ন হতে পারে, যখন শ্রেণিকক্ষে ক্লাস হতো, তখন কি এই ধরনের শঙ্কা শিক্ষকদের মধ্যে ছিল না? নিশ্চয়ই তখনো ছিল। কিন্তু তখন তো আর কোনো কথার ভিডিও রেকর্ড থাকত না।

তবে শঙ্কা এখন বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্প্রতি দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দুজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাময়িক চাকরিচ্যুতি ঘটেছে একজনের ক্ষেত্রে। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য এই আইন প্রয়োগ করেছেন। তাই এই অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে এসেছে: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিজস্ব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানতত্ত্বীয় তর্ক-বিতর্ক করার মনস্কতা তৈরির স্বাধীনতা আসলে কতটুকু থাকবে?

কেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকেরা এ বিষয়টি নিয়ে বেশি আতঙ্কিত? কারণ, সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর বেশির ভাগেরই কাজের জায়গা সমাজ, রাষ্ট্র, সামাজিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে। সেখানে ভিন্নমত, বিচিত্রতা এবং আলোচনা-সমালোচনাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেখানে ব্যক্তি, রাষ্ট্র-সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, লিঙ্গ, যৌনতা, প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের বিষয়-সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব—সব নিয়ে আলোচনা হয়, হওয়ারই কথা। এসব বিষয়ে কারও মতামতের সঙ্গে কারওটা না–ও মিলতে পারে। মতাদর্শিক বিতর্ক তৈরি হতে পারে বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রাধান্যশীল ভাবধারার সঙ্গেও। যুক্তিতর্কই সামাজিক অনুষদভুক্ত ডিসিপ্লিনগুলোর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। যুক্তি নিয়ে সব যুগেই নানা ধরনের মতপার্থক্য আছে, অনেকের সঙ্গেই অনেকের মেলে না, মিলবেও না।

এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। এর ধারণা আলাদা, ইতিহাস আলাদা। শিক্ষকতা আর দশটি পেশার মতো নয়। শিক্ষকতা একটি দায়িত্ব। শিক্ষকদের কাজ শুধু ক্লাস নেওয়া বা পরীক্ষার খাতা দেখা নয়; শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা, গবেষণার দক্ষতা এবং মনস্কতা তৈরি, তাদের অধিকার এবং অসুবিধাসহ সবকিছুতেই শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক জড়িত। সেই সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটে পাঠদানেও।

আর সেই পাঠদানেও যদি দুই পক্ষই অস্বস্তিতে থাকেন, ভয়ে থাকেন, আতঙ্কে থাকেন, সেটির প্রভাব পড়বে পাঠদানের মানের বেলাতেও। জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিসরেও যদি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের করাত সব সময় খাড়া থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মূল ধারণাই পাল্টে যায়। তাই যখন শিক্ষকেরা এই ভয়ের জন্য অনলাইন ক্লাসেও জড়তা বা আতঙ্ক বোধ করেন, তখন মনে হয় আমরা যেন কোথাও বাঁধা পড়ে আছি। আমাদের মনোজগৎ মুক্ত নয়। আমরা ভয় পাই। মামলার ভয়, সামাজিকভাবে হেনস্তার ভয়, হুমকির ভয়, তারপর চাকরি হারানোর ভয়। ভয়ডরহীনভাবে যদি শিক্ষার্থীদের সামনে কথা না–ই বলতে পারি, কিংবা শিক্ষার্থীরাও যদি ভয়ের কারণে তাঁদের মনে থাকা প্রশ্ন তুলে ধরতে না পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রয়োজনই–বা কী? তাই রাষ্ট্রেরই উচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে থেকে সবাইকে মুক্ত রাখা।

লেখক : জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039479732513428