গভীর আবেগ নাকি মোহ? যখন কেউ অনলাইনে থাকে তখন মানব আচরণের এই দুটি প্রকাশের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্য আলাদা করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী এবং বিবিসির উপস্থাপক অ্যালেকস ক্রতোস্কি বোঝার চেষ্টা করেছেন যে কীভাবে মোহগ্রস্ত আচরণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন যাদের অন্যের বিষয়ে জানতে চাওয়ার প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিত, বাধাহীন এবং সর্বগ্রাসী হয়ে গেছে। এমন আচরণ থেকে বের হওয়ার উপায়ও বলেছেন তিনি। শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।
বিপরীতমুখী ঈর্ষা
কিশোর বয়সে প্রেমে পড়েছিলেন জ্যাক স্টকিল। কিন্তু শিগগিরই তিনি তার বান্ধবীর অতীত জীবন নিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। যদিও এর আগে আর কারও বিষয়ে এমনটা হয়নি তার। তিনি কখনোই একজন ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি ছিলেন না। কিংবা তার বান্ধবী তাকে ধোঁকা দিতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল না তার। কিন্তু তার বান্ধবীর সাবেক এক সঙ্গীকে নিয়ে একটি মন্তব্য হঠাত্ই তার মস্তিষ্কে একটি সুইস খুলে দেয়। এ বিষয়ে জ্যাক বলেন,‘এই একটি জিনিসই আমার মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমি তার অতীতের খুব ছোটো ছোটো বিষয় নিয়েও খুব আগ্রহ বোধ করতাম। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তার প্রেমজীবন কেমন ছিল সেসব নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলাম আমি।’ জ্যাক আরো বলেন,‘আমি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টও দেখতাম, ভাবতাম এই ব্যক্তিটি কেমন? কিংবা ঐ ছবিতে কে? এবং এই কমেন্ট দিয়ে কি বোঝায়।’
সাইবার নজরদারি বা সাইবার স্টকিং
সাইবার স্টকিং শব্দটি ২০১০ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে সংযুক্ত করা হয়। এটি হচ্ছে স্টকিং বা কোনো ব্যক্তির ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত নজরদারির ডিজিটাল রূপ। যা শুধু অনলাইন জগতেই ঘটে থাকে এবং এটি পুরোপুরি প্রযুক্তিগতভাবেই হয়। স্টিনা স্যান্ডার্স একজন সাংবাদিক যিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সম্পর্কে লেখালেখি করেন। ছয় বছর আগে যখন তার সঙ্গী তাকে কোনো কারণ ছাড়াই ছেড়ে চলে যায়, তখন এর কারণ জানতে তিনি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো মোহগ্রস্তের মতো পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,
‘সে কেন আমাকে ছেড়ে গিয়ে ছিল এ নিয়ে কখনোই ভাবনা বন্ধ করতে পারতাম না আমি। আর এর জন্য অনলাইনে প্রকাশিত তার নতুন সঙ্গীর সঙ্গে বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি দেখাই আমার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অন্যের জীবনে আমাদের উঁকি মারার একটি জানালা খুলে দেয় এবং বিশাল তথ্য ভান্ডারে প্রবেশের সুযোগ করে দেয় যা আগে কখনো ছিল না। অনলাইনে আমরা যে তথ্য দেই—যখন কারো সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে চেক ইন দেই কিংবা কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর কথা জানাই তখন সেটা নতুন নতুন সূত্র ও সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে। বিপরীতমুখী ঈর্ষার সমস্যা রয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সঙ্গীর অতীত জীবন নিয়ে জানার আগ্রহ অনেক বেশি হয়ে দেখা দিতে পারে। অতীতে, কারো সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন এটা বেশ সহজ।
কমেডিয়ান অ্যানড্রিয়া হাবার্ট বলেন, ‘তার যখন ২০ বছর বয়স ছিল, তখন তার সঙ্গী তাকে ছেড়ে যায়। তার সঙ্গে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দেয় সে। এমনকি এমন আচরণ শুরু করে যে, তার জীবনে তার অস্তিত্বই কখনো ছিল না।’ তিনি জানতেন যে, তার সঙ্গী অন্য কারো সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর নিয়মিত তাকে অনলাইনে স্টক করা শুরু করেন তিনি। আর এটি তিনি বারবারই করতে লাগলেন। তিনি আরো বলেন ,‘যখন আপনাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, তখন আপনি অন্যের প্রোফাইলে দিনে ৬০-৭০ বার দেখবেন।’
এ ধরনের সমস্যায় করণীয়
সম্প্রতি গবেষণাগুলো থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—মানুষ যখন অনুভব করে যে, তারা অনলাইনে অন্যের পেছনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে বা তারা যদি তাদের আচরণ নিয়ে দোষী অনুভব করে তাহলে সে বিষয়ে তাদের কথা বলা উচিত। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলুন। যারা মনে করেন যে, তাদের জীবন এতটাই প্রভাবিত হয়েছে যে, তারা আটকে গেছেন বলে অনুভব করছেন তাদের জন্য পেশাদারদের সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। জ্যাক জানান, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পুরো সমস্যাটাই আসলে তার সৃষ্টি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু এটাকে আরো বেশি খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে... ‘এটা থেকে বেরিয়ে আসার শুরুতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, শিগগিরই আমাকে এগুলো ছেড়ে দিতে হবে।’
অনলাইনে তিনি কম সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি যাতে তার সাবেক সঙ্গীর বিষয়ে আগ্রহী না হন তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা শুরু করেন। তিনি আরো বলেন,‘আপনাকে সেই লোভ সামলাতে বেশ কঠোর হতে হবে। কারণ ঐ লোভ সহসাই আপনাকে ছেড়ে যাবে না।’
আর অ্যানড্রিয়া বলেন, ‘তিনি জানতেন যে, সামনে এগিয়ে যেতে হলে ভিন্ন পথে এগুতে হবে তাকে। সম্পর্ক ভাঙার পর অনলাইনে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে ছিলেন তিনি। কারণ তিনি আবার মোহগ্রস্তদের মতো আচরণে অভ্যস্ত হতে চাননি। সমস্যাটি বুঝতে পারাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। তার পর থেকে আর কোনো সাবেক সঙ্গীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল দেখেন নি তিনি।