ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম - Dainikshiksha

ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজন সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাম্প্র্রতিক সময়ে দেশে বিশেষ করে ঢাকায় ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ দেখা দিয়েছে। তবে এবারের ডেঙ্গুর ধরনকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ২৪ জুলাই মঙ্গলবার এক দিনেই ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৪৭৩ জন। জুনের দ্বিগুণেরও বেশি ডেঙ্গু রোগী জুলাইয়ে। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালকে মশার মৌসুম ধরা হয়। সেই হিসাবে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। শনিবার (২৭ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. মো. সহিদুজ্জামান।

মশা ও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ সময় চলে নানা কর্মসূচি, হাতে নেওয়া হয় বড় বড় কর্মপরিকল্পনা, বৃদ্ধি হয় বাজেট। এভাবে মশা নিধনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। ঢাকার সিটি করপোরেশন মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো অন্ধকারে আছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ আইসিডিডিআরবি ঢাকায় ব্যবহৃত ওষুধে মশা না মরার প্রমাণ মিলেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারে, প্রথমত ব্যবহূত কীটনাশকের পরিমাণ ও গুণগত মান—এ সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত মশার মধ্যে কীটনাশক বা বালাইনাশক প্রতিরোধী সক্ষমতা তৈরি হওয়া। তাই জনস্বার্থে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে বিষয় দুটি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এ অবস্থায় মানুষকে মশার হাতে ছেড়ে দিয়ে সিটি করপোরেশনগুলো নতুন কার্যকর ওষুধ আমদানির অপেক্ষায় থাকবে, নাকি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? অবশ্য এক সিটি করপোরেশন বলেছিল, নিবন্ধন নেই এমন নতুন ওষুধের অনুমোদন নেওয়া যেহেতু একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই তারা বিকল্প হিসেবে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার’ অনুমোদন নিয়ে নতুন ওষুধ ও নতুন কম্পোজিশন আমদানি করবে। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নতুন কোনো কীটনাশক আমদানি সমীচীন হবে না।

বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা নিয়ন্ত্রণাধীন ‘বালাইনাশক ও মাননিয়ন্ত্রণ’ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ৭৩টি উপাদান রয়েছে (ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী)। এগুলোর মধ্যে কিছু একক উপাদান এবং কিছু যৌথ উপাদান বা মিশ্রণে তৈরি। নিশ্চয়ই সবগুলো মশার বিরুদ্ধে অকার্যকর নয়। এসব অনুমোদিত বালাইনাশকের মধ্যে থেকে কার্যকর বালাইনাশক খুঁজে পাওয়া জটিল কিছু নয়। তা ছাড়া আইসিডিডিআরবি এরই মধ্যে পারমেথ্রিনের পরিবর্তে ম্যালাথিয়ন ও ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহার করতে সুপারিশ করেছে। এর আগে ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে মশার লার্ভা (বাচ্চা) মারতে মেলাথিয়ন সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ডাইমেথোয়েট, ফেনিট্রোথিওন, ডেল্টামেথ্রিন, ক্লোরপাইরিফসের কার্যকারিতাও দেখতে পান তাঁরা।

বিভিন্ন দেশে অরগানোফসফরাস ও পাইরিথ্রইডস গ্রুপের বালাইনাশকের বিরুদ্ধে মশার প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে ওঠার রিপোর্ট রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যবহৃত বালাইনাশকের প্রতি মশার প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ছাড়া কৃষিকাজে পোকামাকড় দমনে অপরিমিত কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহারে মশার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়ে গিয়ে এসব রোগের প্রকোপ দেখা দিতে পারে। তাই মশা নিধনে অবশ্যই নতুন নতুন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি এসব বালাইনাশকের ওপর মশার প্রতিরোধক্ষমতা প্রতিহত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন—অরাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার, জৈব নিয়ন্ত্রক, পরিবেশে ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা। আমরা অনেকেই মনে করি মশা নিয়ন্ত্রণ মানে মূলত স্প্রে করা; কিন্তু মনে রাখতে হবে স্প্রে করা হলো সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ছোট একটি অংশ মাত্র। এ জন্য মশা নিয়ন্ত্রণে মোট বাজেটের বেশির ভাগ মশার প্রজনন রোধে ব্যবহার করতে হবে।

প্রকৃতিতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার অবস্থান

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বছরের বিশেষ সময়ে কোথা থেকে আবির্ভাব হয় তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। আমাদের প্রকৃতিতেই এসব জীবাণু তাদের জীবনচক্র রক্ষা করে চলছে। মশা বংশপরম্পরায় এসব জীবাণু বহন করতে পারে অর্থাৎ ডিমের মাধ্যমে বাচ্চাতে এসব জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাস সাধারণত মানুষ ও মশার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানর, কুকুর, বাদুড়সহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এর অস্তিত্ব মিলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকুনগুনিয়া মানুষ ছাড়াও বানর, বাদুড়, ইঁদুর ও পাখিতে হতে পারে। মহামারির সময় আক্রান্ত এলাকার পশুপাখিতে এসব ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে এবং সুপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন রয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া এডিস মশার ডিম শুষ্ক অবস্থায় প্রায় ৯ মাস বেঁচে থাকতে পারে এবং সামান্য পানির সংস্পর্শে এলে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।

সমন্বিত পদক্ষেপ

নির্দিষ্ট সময় দিয়ে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম। শুষ্ক ও আর্দ্র উভয় মৌসুমে এডিস মশা সক্রিয় থাকে, তবে বর্ষার সময় এদের আধিক্য দেখা যায়। তাই এ সময়টিতে জরুরি ভিত্তিতে মশা মারতে প্রয়োজনীয় কীটনাশক আক্রান্ত এলাকাগুলোতে মোটরযানে বা হেলিকপ্টারে করে স্প্রে করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে নিয়মিত ময়লা-অবর্জনা পরিষ্কার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এলাকাভিত্তিক জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ সাপেক্ষে অভিযান চালিয়ে যেতে হবে। মশা ও অন্য রোগবাহী কীট নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি জেলায় স্থানীয় ইউনিট তৈরি করে সমন্বয়ের মাধ্যমে সারা বছর কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

পানিতে থাকা অবস্থায় মশার প্রজনন স্থান নির্ণয় ও নির্মূল করা মশা নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর অংশ। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। জমে থাকা পানি পরীক্ষা করে সেখানকার মশার লার্ভা নষ্ট করতে হবে এবং এসব জায়গায় যাতে পানি জমে থাকতে না পারে বা মশার প্রজনন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুধু নিজের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখলেই চলবে না, আশপাশের জায়গাটুকু যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

মশার বাসস্থানের পানিতে কেরোসিন বা মবিল ঢেলে মশার প্রজনন রোধ করা যায়। পানিতে কেরোসিন বা মবিল ব্যবহার পরিবেশবান্ধব নয়। এসবের পরিবর্তে সয়ারিন, নিম বা অন্য যেকোনো সহজলভ্য তেলজাতীয় পরিবেশবান্ধব পদার্থ ব্যবহার করে মশার প্রজনন রোধ করা যায়। এ ক্ষেত্রে এসব পদার্থ পানির ওপরে একটি স্তর তৈরি করে মশার লার্ভাকে অক্সিজেন নিতে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে লার্ভাগুলো সহজেই মারা যায়। ১০০ বর্গফুটে এক চা চামচ ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু মাছ চাষের জায়গায় তেলজাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না, এতে মাছও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে। এভাবে বাড়ির আশপাশে, বস্তিতে, পরিত্যক্ত জায়গায় বা ড্রেনের জমে থাকা পানিতে তেল ব্যবহার করে সহজেই মশার প্রজনন রোধ করা সম্ভব। ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করেও মশার লার্ভা মারা যায়।

গবেষণার বিষয়

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কীটপতঙ্গের প্রজনন বেড়ে যেতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তন ও কালের আবর্তে পরিবর্তিত হতে পারে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের ধরন। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এডিস মশার প্রজননে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা উপাদান কাজ করছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। মশার ঋতুতে দেশজুড়ে মশার বিস্তারের একটি মানচিত্র তৈরি করতে হবে। কোন এলাকায় কোন জাতের মশা পাওয়া যায় তার একটি পরিষ্কার চিত্র থাকা প্রয়োজন। প্রতিবছর একবার হলেও মশায় ব্যবহৃত বালাইনাশকের প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না তা মনিটরিং করা প্রয়োজন। একই মশায় ও প্রাণীদেহে একই সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া থাকতে পারে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ফলপ্রদ নিয়ন্ত্রণে মশা ও মানুষের পাশাপাশি অন্য উৎসগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে। যেমন—গৃহপালিত ও বন্য প্রাণী এবং বনজঙ্গলে থাকা এডিস ও অন্যান্য মশায় এসব রোগের জীবাণু আছে কি না তা শনাক্ত করা প্রয়োজন এবং বিদ্যমান ভাইরাসের জিনগত বৈচিত্র্য নিরূপণ করা প্রয়োজন।

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া আমাদের জাতীয় সমস্যা, তাই আতঙ্কিত না হয়ে এসব রোগের নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারলে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো আমরাও মশাবাহিত রোগমুক্ত দেশ গড়ে তুলতে পারব।

 

লেখক : অধ্যাপক, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069119930267334