ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে আসছে সারাদেশেই। আক্রান্ত কমছে, হাসপাতালে ভর্তিও কমছে। তবে এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে পাঁচ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষই বেশি। তাদের মধ্যে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশি আক্রান্ত হয় শিক্ষার্থীরা। এক হিসাবে জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৭৫ শতাংশই শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও কিশোর পর্যায়ে মৃত্যু বাড়ছে। সরকারের আইইডিসিআরের পর্যালোচনায় এ তথ্য জানা গেছে। সর্বশেষ গতকাল বুধবার এই তালিকায় যুক্ত হলো রাজধানীর আজিমপুরে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ইশরা তাসকিন অস্মিতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের চেয়ে বাইরে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে বলেই আক্রান্তদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও পুরুষের সংখ্যা বেশি। বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন তৌফিক মারুফ।
সরকারের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির তথ্য অনুসারে, এবার এখন পর্যন্ত তাদের হাতে আসা ১৯২টি মৃত্যু-তথ্য থেকে পর্যালোচনা সম্পন্ন হয়েছে ৯৬ জনের। সেখান থেকে যে ৫৭ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করা গেছে তাদের ভেতর ১৮ বছরের নিচে রয়েছে ২১ জন। তবে মৃত মোট ১৯২ জনের মধ্যে কতজন ১৮ বছরের নিচে তা এখনো বের করার কাজ চলছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশের বয়স ১৫-২৫ বছরের মধ্যে। এর পরেই রয়েছে ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী লোকজন, যারা মোট আক্রান্তদের মধ্যে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ ৫-১৫ বছর বয়সী, ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ ৩৫-৪৫ বছর বয়সী, ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী, ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ ৪৫-৫৫ বয়সী, ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ ৫৫-৬৫ বয়সী, ২ দশমিক ৪২ শতাংশ এক বছরের নিচে এবং ১ দশমিক ৬৭ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে।
এই পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৯ দশমিক ২৯ শতাংশ রোগীর বয়স ২৫ বছরের নিচে। আইইডিসিআরের ২৪ হাজার ৫০১ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুসারে, এবার আক্রান্তদের মধ্যে দিন দিন পুরুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, আক্রান্তদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ পুরুষ আর ৩৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ নারী। এ ছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৭৫ শতাংশই শিক্ষার্থী।
আইইডিসিআর পরিচালক ও সরকারের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটির প্রধান ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখতে পাচ্ছি, এবার ঘরের চেয়ে বাইরেই বেশি আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ ঘরে সবাই সচেতন থাকলেও বাইরে কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে সচেতনতার মাত্রা কম ছিল। অন্যদিক থেকে বললে, এবার এডিসের প্রজনন বা বিচরণও ছিল বেশি।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে, আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষার্থী রয়েছে।’
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতো আমরাও শুরু থেকেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্ক ছিলাম এবং এখনো আছি। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সারা দেশে চিঠি দিয়েছি। ঈদের ছুটিতেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রম চলেছে। ওষুধ দেওয়ানো হয়েছে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে।’
নতুন ভর্তি ৮২০ : গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত আরো ৮২০ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। একই সময়ে হাসপাতাল ছেড়ে গেছে ৯৭৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তারের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ভর্তি হয়েছে ৩৪৫ জন ও ঢাকার বাইরে ৪৭৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫৬ জন। এ ছাড়া মিটফোর্ড হাসপাতালে ৪৯ জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২২ জন ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে ২৯ জন উল্লেখযোগ্য। একই সময়ে ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩১ জন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭৩ হাজার ৫৬৫ জন, হাসপাতাল ছেড়ে গেছে ৬৯ হাজার ৭৮৫ জন, চিকিৎসাধীন আছে তিন হাজার ৫৮৮ জন। আর ১৯২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।
ভিকারুননিসার ছাত্রীর মৃত্যু : গতকাল সকালে রাজধানীর লালমাটিয়ার মিলেনিয়াম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ইশরা তাসকিন অস্মিতা। পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ২২ আগস্ট অস্মিতার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। পরে তাকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান অবস্থার অবনতি ঘটলে আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে; কিন্তু সময়মতো আইসিইউ বেড খালি না থাকায় স্বজনরা তাকে ২৬ আগস্ট নিয়ে যায় মিলেনিয়াম হাসপাতালের আইসিইউয়ে। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।
অস্মিতার বাবার নাম আমানত মাওলা টিপু। তিনি আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের আইসিটি ব্যবস্থাপক এবং মা হেনা নূরজাহান কবি-ছড়াকার। তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ। ঢাকার আজিমপুর এলাকায় তাদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। সেখানেই তারা বসবাস করে বলে জানান আমাদের বিশ্বনাথ (সিলেট) প্রতিনিধি।