ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জয়ী হোক - দৈনিকশিক্ষা

ডাকসু নির্বাচনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জয়ী হোক

ড. কাবেরী গায়েন |

আমার সরাসরি ছাত্র, বর্তমানে সাংবাদিক, আলী আসিফ শাওন যেদিন ডাকসু নির্বাচনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছিলেন, সেদিন তিনি আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শাওনদের সঙ্গে নতুন সব মুখ যুক্ত হয়েছে বছরে বছরে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে। হাইকোর্টের আদেশ জারি হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দিয়ে। ৩ মার্চ তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে ২৮ বছরের অনিয়ম ভেঙে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে ১১ মার্চ। হাতে ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়। ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনকারী সব শিক্ষার্থীকে অভিনন্দন। অভিনন্দন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও ডাকসু নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য।

ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই আমাদের অনেক বছরের মেনে নেওয়ায় অভ্যস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসর যেন হঠাৎ অনেকটাই পাল্টে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় তিন দশক পরে তারুণ্য ফের প্রাণ পেয়েছে। নানা আয়োজনে ক্যাম্পাস মুখরিত। যে ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি দীর্ঘকাল, তারা ফের ফিরেছে ক্যাম্পাসে। মিছিল করছে। মধুর ক্যানটিনে বসেছেন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনের নেতা কর্মীরা। যে শিক্ষার্থী কয়েক দিন আগেও উদাসীন ছিলেন রাজনীতি সম্পর্কে, তিনিও নির্বাচনে দাঁড়িয়ে গেছেন। উৎসাহের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমার নিজের বিভাগে একজন ডাকসুর ভিপি, একজন জিএস প্রার্থী, দুজনই স্বতন্ত্র। সেই সঙ্গে হলে নির্বাচন করছেন বেশ কয়েকজন।

ক্যাম্পাসে এখন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ কিংবা স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীরা এই যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন, এর মধ্য দিয়েই ডাকসু নির্বাচনের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে কিংবা হলে প্রবেশে বাধা পেয়েছেন এত দিন, সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত না হোক তবু তাঁরা ফিরেছেন এর প্রতীকী মূল্য আছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই ফিরে আসাকে পরিস্থিতির অগ্রগতি বলে মনে করি।

শুরু থেকে অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা কর্মীরা প্রচারণার যেসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, অন্য প্রার্থীরা সেসব পাচ্ছেন না, বিশেষ করে হলে গিয়ে প্রচারণা চালানোর সময় বাধাগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগ এনেছে ছাত্রদল ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটসহ অন্যান্য প্যানেলের সদস্যরা। এই আশঙ্কা থেকে ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্রসংগঠন এবং স্বতন্ত্র জোট ও প্রার্থীদের দাবি ছিল নির্বাচনী বুথ হলে নয়, একাডেমিক ভবনগুলোতে স্থানান্তরের। শিক্ষার্থীদের সব কাজের প্রাথমিক কেন্দ্র হল এই যুক্তিতে কেন্দ্র স্থানান্তরের দাবি গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। রয়েছে ছাত্রলীগের কোনো কোনো সদস্যের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন বিষয়ে কর্তৃপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করা হলেও প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগ। ফলে অসন্তোষ এবং উদ্বেগ আছে।

এবারের নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন ৪৩ হাজার ভোটার। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক বেশি। ভিন্ন দুটি প্যানেল থেকে দুজন নারী প্রার্থী ভিপি এবং জিএস পদে নির্বাচন করছেন। তবে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের প্যানেলে নারী শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুবই কম। এবারের নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রচুর স্বতন্ত্র প্রার্থী, এমনকি স্বতন্ত্র জোটের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনের দিকে মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের ইশতেহার নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এটি ছাত্ররাজনীতির নতুন দিক বদলের ডাক দিচ্ছে কি? রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত বা প্রভাবাধীন ছাত্রসংগঠনের দিক থেকে সরে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ধারার রাজনীতির ডাক দিচ্ছেন এসব প্রার্থী। এসব প্রার্থী কেবল হুজুগে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন, এমন মোটেই নয়, বরং অনেকেরই রয়েছে ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের সরাসরি অভিজ্ঞতা। জাতীয় রাজনীতিতে মন্দের ভালো বেছে নেওয়ার উদাহরণের বিপরীতে নিজেদেরই ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের ধারক-বাহক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের ফল যাই হোক, ক্যাম্পাসে নতুন রাজনীতি সমাগত, এমন ইঙ্গিত হিসেবে ধরা যেতে পারে স্বতন্ত্র জোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সুচিন্তিত ইশতেহারগুলোকে। অনেক বছর ধরে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোর অনুপস্থিতি, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের বিপরীতেও আজকের এই অবস্থানটি তৈরি হতে পারে।

এবারের নির্বাচন প্রচারণার দিক থেকেও ব্যতিক্রমী। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপুল প্রয়োগ দেখছি আমরা। ব্যক্তিগত ও দলীয় বা জোটগত জনসংযোগ, পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফলে যেসব প্রার্থী, দল বা জোট হলে গিয়ে প্রচারণা করতে পারছে না, তারাও তাদের বার্তাটি ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে।

এসব প্রচেষ্টায় ডাকসু নির্বাচনের জন্য শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট। স্পষ্ট ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব। ডাকসুর অনুপস্থিতি ছিল ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের পরিপন্থী। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা নীতিনির্ধারণী বিষয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, অথচ নিয়মিত সিনেট, সিন্ডিকেট ও শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন না হওয়া ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যৌথ অবদান রাখার মৌলিক সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন। অন্যদিকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, সিভিল ও মিলিটারি বু্যরোক্রেসি প্রভাব বিস্তার করেছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে জাতি রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতার সংকটে।

এই দীর্ঘ সময়ে ডাকসুর অনুপস্থিতিজনিত শিক্ষকদের একতরফা রাজনীতি ও ক্ষমতা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের ভারসাম্যকেও খণ্ডিত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক হওয়ার কথা জুনিয়র-সিনিয়র স্কলারের, স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ তেমনই ছিল, যাকে ভিত্তি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যও সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে বরাবরই পথ দেখিয়েছে। জাতীয় রাজনীতি এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন জাতি হতাশ এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচনে ভোটারদের একধরনের নীরব প্রত্যাখ্যান দেখেছি আমরা, সে সময় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এই ডাকসু নির্বাচন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বডিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বরাবরই সুষ্ঠু হয়। ডাকসুতেও এর অন্যথা হবে না, এই আশা করতে চাই।

নির্বাচনে যারাই জিতে আসবেন শিক্ষার্থীদের ভোটে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অসংগতির কথা উঠে এসেছে, এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে গণরুম ও সব শিক্ষার্থীর সহাবস্থান বিষয়ে, তারা সেসব প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে আন্তরিক হবেন আশা করি। সব আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে সুষ্ঠু নির্বাচনে জিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক, হয়ে উঠুক দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট হল সংসদের নেতৃত্ব মডেল। জিতে যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: প্রথম আলো

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040080547332764