ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নূরুল হক নূরসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর যৌথভাবে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের (বুলবুল-মামুন) নেতাকর্মীরা।
মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোন রাষ্ট্রপতিকে আইনি নোটিশ দেয়ার প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের এ অংশটি রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করে। মানববন্ধন শেষে একটি মিছিল নিয়ে তারা ডাকসু ভবনের দিকে যাত্রা করে। বিভিন্ন দৈনিকের খবরে প্রকাশ, সেখানে বিনা উসকানিতে ডাকসু ভবনের দোতলার প্রবেশপথে তারা ইট-পাথর ছুড়তে থাকে। মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, তারপর নূরসহ প্রায় ৩০ জন ছাত্রকে বেধড়ক মারধর করে। ফলে বেশ কয়েকজনের হাত-পা এবং বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। গুরুতর আহত কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়, যার মধ্যে একজনকে আইসিউতে রাখা হয়। ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের এ বর্বর আক্রমণটি যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
মানববন্ধনটি ছিল রাষ্ট্রপতির পক্ষে এবং গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে। নোটিশটি যদি অন্যায় এবং অবৈধ হয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনি এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ও সরকারের আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ‘দেশপ্রেমিকরা’ যদি তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তা তারা মানববন্ধনের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন।
তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তারা মিছিল করেছেন। কিন্তু সে মিছিল কেন ডাকসু ভবনের দিকে গেল এবং তা উপরোক্ত সহিংস ঘটনাবলির জন্ম দিল, সেটা আমাদের প্রশ্ন। আসলে তাদের উদ্দেশ্য যে ছিল ডাকসু ভিপি নূরুল হক নূর এবং তার সহযোগীদের মারধর করা, তা বেশ পরিষ্কার।
ছাত্রলীগের নেতাদের কেউ ডাকসু ভিপি নির্বাচিত না হয়ে কেন নূর নির্বাচিত হল, এটাই ছাত্রলীগ এবং মঞ্চধারীদের (যারা ছাত্রলীগেরই সদস্য) আসল ক্ষোভের কারণ। আর এ কারণেই নূর বারবার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অতীতে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন এ ছাত্রলীগ নামধারীরাই লাঠি, বাঁশ, রড নিয়ে ভিপি এবং ডাকসু ভবনের ওপর সন্ত্রাসীসুলভ হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনকে রক্তাক্ত এবং কালিমালিপ্ত করে।
আমরা এ বর্বর হামলার দৃশ্য চাক্ষুষ টিভিতে দেখলাম। তারপরও গণমাধ্যমে দেখা গেল বর্বরতার এ হোতারা নূর এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ এনে আদালতে মোকদ্দমা করেছে। একেই কি বলে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’! কবি গুরু বলেছিলেন, ‘পাপ যদি নাহি মরে যায় আপন লজ্জায়...’।
বাংলাদেশে কিছুকাল যাবত দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের লজ্জা পেতে দেখা যায় না। এটাও বলা দরকার, এ বর্বর আক্রমণের হুকুমদাতা দেখা যাচ্ছে দুই ছাত্রলীগ নেতা। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং জামায়াত-শিবিরের কিছু ছাত্রকেও তখন তারা নূরের কক্ষে পেয়েছে।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কি ডাকসু ভিপির সঙ্গে দেখা করতে পারে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা হরহামেশা আসেন। জামায়াত-শিবিরপন্থী ছাত্রদের অজুহাত তুলে নিরপরাধ ছাত্রদের মারধর করা, এটা ছাত্রলীগের বিপথগামীদের একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুয়েটে আবরারকে জামায়াত-শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলে। কারও গায়ে বা কপালে কি লেখা থাকে জামায়াত-শিবির? আসলে ‘যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Give the dog a bad name and kill it. অর্থাৎ কুকুরকে একটি খারাপ নাম দাও এবং তাকে বধ কর।
ব্যক্তিগতভাবে আমি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি এবং মতাদর্শ পছন্দ করি না। ১৯৭৮ থেকে ৮৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সন্ত্রাসও কম দেখিনি। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া যে কোনো অপছন্দের মানুষকে শুধু সন্দেহের বশে অমানুষিক নির্যাতন করবে বা মেরে ফেলবে, তা কোনো বিবেকবান মানুষ সমর্থন করতে পারে না।
দেখলাম, আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ এবং তোফায়েল আহমেদ নূরকে ভারতে বর্তমানে চলমান সংখ্যালঘু মুসলমানবিরোধী নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেয়া বা বক্তব্য প্রদানের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
এর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রতিবাদে সোচ্চার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এর বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে।
তাছাড়া পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে নিজের বাড়িতেও তা ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। নূর তাই বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত-সচেতন নাগরিকের মতোই হয়তো তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
হামলাকারীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে দাবি করে। কয়েকদিন আগে দলটির জাতীয় সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে দলীয়প্র্রধান শেখ হাসিনা দলের নীতি ও আদর্শ মেনে চলা এবং ত্যাগের রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দলীয় সহকর্মীদের ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে বলেছেন।
আর সে আহ্বানের বিপরীতে তার অনুসারী দাবিদাররা ডাকসু ভিপি নূর ও তার সহযোগীদের জঘন্য নির্যাতনের অনুষ্ঠান করেছে। ঘটনার আলামত নষ্ট করতে ডাকসু ভবনের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজও গায়েব হয়ে গেছে।
ছাত্র নামধারী এ দুর্বৃত্তরা যে গুরুতর অপকর্ম করেছে, তা সরকার বুঝতে পেরেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে এবং তিনজনকে রিমান্ডে নিয়েছে। তাছাড়া ঘটনায় জড়িতরা দলীয় লোকজন হলেও এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
আসলে এরকম জঘন্য ঘটনার হোতারা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বন্ধু নয়, বরঞ্চ শত্র“। এরা কোনো আদর্শবাদ বা নীতি-নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত নয়। সুবিধাবাদ এদের আদর্শ এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি এদের উদ্দেশ্য। এরা সরকারি দলের ভক্ত সাজে তাদের অপকর্ম ঢাকতে বা সম্ভাব্য শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেতে।
এটা শুধু নূরকে হেনস্তা করাই নয়, এটা আমাদের মাতৃপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টাও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এখানকার ছাত্র-শিক্ষকরাই এসব আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজ সৃষ্টিতেও এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা অনন্য। অথচ সাম্প্রতিক এক জরিপে বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি।
এর কারণ হল শিক্ষা ও গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র-শিক্ষকদের অপ্রতুলতা ও অনুজ্জ্বলতা। জাতি হিসেবে এটা আমাদের লজ্জার কারণ। এখন দেখা যাচ্ছে কিছুসংখ্যক ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীর অবাধ বিচরণ ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির পবিত্র প্রাঙ্গণ।
অন্যদিকে গত কয়েক বছরে অসংখ্য সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে প্রাচীন এ উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রটিকে সার্টিফিকেট বিক্রির কারখানায় পরিণত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি, যিনি আচার্যও বটে, সাম্প্রতিক এক সমার্তন ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিনে পাবলিক এবং রাতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করেছেন।
কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী মনোভাবসম্পন্ন শিক্ষকের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি আলোকমালায় সজ্জিত নৈশকালীন বিপণিবিতানে পরিণত হোক, সেটা দেশের শিক্ষানুরাগী মানুষ চায় না। সন্ত্রাসী ছাত্র এবং ব্যবসায়ী শিক্ষকের হাত থেকে দেশের এ সুবিখ্যাত এবং প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বাঁচানো এখন জাতীয় কর্তব্য।
লেখক: মো. মইনুল ইসলাম, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়