ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বাস্তবতা ও বিবেচনা - দৈনিকশিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্সের বাস্তবতা ও বিবেচনা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মূলত আমাদের দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আর্থিক, ব্যাংকিং, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সেক্টরের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে ১৯৯৯ সালে এমবিএ (ইভিনিং) প্রোগ্রাম খোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর ২০০০ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের বিভিন্ন বিভাগে এই সান্ধ্যকালীন কোর্স শুরু হয়। বর্তমানে ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটেও এই সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২০০ শিক্ষকের মধ্যে ৬৮৫ জন শিক্ষক এই কোর্সে পাঠদান করছেন। সম্প্রতি সান্ধ্যকালীন এসব কোর্স চালু রাখার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত তৈরি হয়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এসব কোর্স পরিচালনা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। এর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স স্থগিত রাখার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন। বুধবার (১১ মার্চ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের ডিনের সমন্বয়ে এ বিষয়ে একটা মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। মূল্যায়ন কমিটি একটা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক বা গাইডলাইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সান্ধ্যকালীন কোর্সে ছাত্র ভর্তির তালিকাভুক্তি বন্ধ রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করে। কমিটি উল্লেখ করে, সান্ধ্যকালীন কোর্স চালানোর সমন্বয়কারী ও শিক্ষক নিয়োগে কিছু ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বিদ্যমান। এ ছাড়া সান্ধ্যকালীন কোর্সের কারণে দিবা শাখার ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অধিকন্তু এই কোর্সের পরীক্ষা কার্যক্রম যথাক্রমে প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা গ্রহণ ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শিক্ষার গুণগত মান নিম্নমুখী হচ্ছে। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা ও নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শগত মতভিন্নতা থাকলেও এ কোর্স অব্যাহত রাখার বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করেন।

বলা বাহুল্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপুল দক্ষ মানবসম্পদের কথা মাথায় রেখে এবং পরিবর্তনশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল রেখে বিগত ২০ বছর ধরে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ এই সান্ধ্যকালীন কোর্স পরিচালনা করে আসছে। একই বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে অন্যান্য অনুষদেও তা চালু হয়েছে। এতে একটা বিশাল অংশের চাকরিরত শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উপকৃত হচ্ছেন ও চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। এই সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে কর্মক্ষম হয়ে গড়ে উঠে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছিলেন, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ফলে সান্ধ্যকালীন কোর্সে অধ্যয়নে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এসব কোর্সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য তথাকথিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন।

সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলো থেকে ডিগ্রি অর্জন করে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে আরও কর্মমুখী করে গড়ে তোলার অনেক উদাহরণ রয়েছে। এসব বিষয় অধ্যয়ন করে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হচ্ছেন, অপরদিকে তারা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ আর্থিক ক্ষেত্রে অনেক ভালোমানের চাকরি বা ব্যবসায়িক কাজে নিযুক্ত হয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছেন। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে পেশাদারিত্বের জ্ঞান, যোগ্যতা ও দক্ষতা বিশেষ প্রয়োজন। অনেকে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থেকেও এই কোর্সে পড়াশোনা করে নিজেদের আরও বেশি শানিত করছেন। চাকরিরত প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের অতিরিক্ত অর্জিত বা লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে পারছেন। বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সান্ধ্যকালীন কোর্স রয়েছে, যেখানে চাকরিরত শিক্ষার্থীরা কাজের ফাঁকে এ ধরনের কোর্স করার মাধ্যমে নিজেদের আরও বেশি করে কর্মদক্ষ করে তুলতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র থেকে জানা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে শুধু বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের কোর্সগুলো থেকে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এই উপার্জিত অর্থের সুবিধাভোগী কি শুধু পাঠদানকারী শিক্ষকরাই! এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, উপার্জিত আয়ের মধ্যে ৩০ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে, ৫ শতাংশ ডিন অফিস তহবিলে, ৩১ শতাংশ শিক্ষক সম্মানী, ১৯ শতাংশ কোর্স প্রোগ্রামের পরিচালনা ব্যয়, ০ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক চিকিৎসা ব্যয়, ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ বিভাগের দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা প্রদান, ১২ দশমিক ৯৩ শতাংশ উন্নয়ন কাজে ব্যয় হয়ে থাকে। বস্তুত সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাধ্যমে শুধু পাঠদানকারী শিক্ষকরাই উপকৃত হচ্ছেন; তা নয়। এটা থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা হয়। আয়ের আরেকটি অংশ দিয়ে বিভাগের জন্য আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, ক্লাসরুম সংস্কারসহ অসংখ্য শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিবাভাগে যেসব ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে তাদের মধ্যে নিডবেজড স্কলারশিপ প্রদান করা হচ্ছে সান্ধ্যকালীন কোর্স থেকে উপার্জিত আয় দিয়ে। যদি নিজ ক্যাম্পাসে এ ধরনের সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু না থাকত, তাহলে শিক্ষকরা বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজনীয় আয়ের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে ছুটতেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সৎ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেয়। তাই এখান থেকে সৎ উপার্জনের মাধ্যমে তারা যদি বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সামান্য আর্থিক প্রণোদনা পায়, তা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন না তুলে এ প্রক্রিয়াকে আরও বেশি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার তাগিদ দেওয়া যেতে পারে। এসব শিক্ষকের অনেকেই সরকারি স্কেলে বেতন পেয়ে থাকেন। শুধু যাদের অনার্স ও মাস্টার্স পর্বে দুটি প্রথম শ্রেণি আছে, তারা শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর দুটি ইনক্রিমেন্ট পান। তাই এ ক্ষেত্রে অতি মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ধরে রাখতে হলে তাদের সৎ উপার্জনের পথটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীই অধিক উপার্জনের আশায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত না থেকে অন্যান্য পেশায় চলে যেতে পারে।

আমাদের দেশে বর্তমানে কম্পিউটার সায়েন্স, অ্যাকাউন্টিং, ব্যাংকিং, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, ফাইন্যান্স, মার্কেটিং, ই-কমার্স সেক্টরে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব সেক্টরে পর্যাপ্ত দক্ষ-যোগ্য জনশক্তির অভাবে বিশাল অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে লোকবল আনতে হয়। এতে আমাদের পরনির্ভরশীলতা বরং বেড়ে যাচ্ছে। তাই সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ করলে এসব প্রফেশনালস তৈরিতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। তবে সান্ধ্যকালীন কোর্সকে ফোকাস করতে গিয়ে মূল শিক্ষা কার্যক্রম যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা, শিক্ষা কারিকুলাম, কোর্স ফি থেকে উপার্জিত আয়, পরীক্ষা পদ্ধতি, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, কোর্স পরিচালক ও শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাকার বিষয়ে নিশ্চয় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে সার্বিক কার্যক্রমটি একটা স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে। এও খেয়াল রাখতে হবে, সান্ধ্য কোর্স চালাতে গিয়ে যেন লাগামহীনভাবে শুধু অর্থ উপার্জনের স্থুল চিত্তাকর্ষে পরিণত না হয়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং কোর্স চালাতে গিয়ে যেন দিবাভাগের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়।

লেখক : হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।   

স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল - dainik shiksha স্কুল-কলেজ, মাদরাসা খুলবে ২৮ এপ্রিল সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha সাত দিন বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিক বিদ্যালয় তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha তীব্র গরমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও বন্ধ ঘোষণা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে : ড. আইনুন নিশাত কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha কারিগরির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha মাদরাসায় ছুটির প্রজ্ঞাপন জারি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050139427185059