ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত সমন্বিত ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা গ্রহণ করা হতে পারে। প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়, ক্যাম্পাসে তীব্র আন্দোলন, ফলাফল বাতিল ও নতুন করে পরীক্ষা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট এবং সর্বোপরি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিষয়টি নিয়ে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার ইমেজ সংকটে না পড়ে, এই সব বিবেচনায় এনে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
ফলাফল বাতিলে দাবিতে ছাত্রলীগের আন্দোলন পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। এ অবস্থায় ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে ‘বৃহত্তর সিদ্ধান্ত’র কথা ভাবছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ নিয়ে মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) সাড়ে ১২টায় ডিনস্ কমিটি বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি দল সমর্থিত এমন একাধিক শিক্ষক জানান, ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তারা এক ধরনের বিপাকে পড়েছেন। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শিক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ চায়, ‘বিষয়টি যেন সুষ্ঠুভাবে সমাধান হয়’। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ফলাফল বাতিলের সিদ্ধান্তের বিষয়েও ভাবতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
তারা আরও বলেন, ঘ-ইউনিটের পরীক্ষার বিষয়ে সরকারের এ ধরনের মনোভাবের কারণেই ছাত্রলীগ ফলাফল বাতিল করে পুনরায় তা গ্রহণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে।
তবে ছাত্রলীগ বলছে, রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই তারা আন্দোলন করছে, কোনো নির্দেশনায় নয়।
এবার ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।
এর আগে তারা পরীক্ষা বাতিলে শিক্ষার্থীর অনশনেও একাত্মতা প্রকাশ করেছিল।
মঙ্গলবার সকালে চার দফা দাবিতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত মৌন পদযাত্রা ও উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেন তারা।
চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে পুনরায় নেয়া অথবা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বিশেষ ভর্তি পরীক্ষা নেয়া; ডিজিটাল জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁস বা অসদুপায় অবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ও আইন ব্যবস্থা নেয়া; সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে জালিয়াতি, প্রশ্নফাঁস বা অসদুপায়ের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া এবং আধুনিক, যুগোপযোগী ও মানসম্মত ভর্তি পরীক্ষার স্বার্থে পলিসি ডিবেটের আয়োজন করা।
অতীত রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় কোনো কর্মসূচিতে যায়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাট আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও আওয়ামী লীগের অবস্থান ও বক্তব্য অনুসারেই ছাত্রলীগ তাদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে।
ফলে ঘ-ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের আন্দোলনেও তেমনটি হয়েছে। কারণ ইতিপূর্বে টানা দুই বছর ঘ-ইউনিটের প্রশ্নফাঁস হলেও সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগকে কোনো কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি।
এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা জানান, তারা বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সঙ্গেও কথা বলেছেন। সেখান থেকে তারা বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান এবং কেউ যাতে এই ঘটনাকে ঘিরে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেই নির্দেশনা পেয়েছেন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, গৌরবের স্থান। এখানের ভর্তি প্রক্রিয়া যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে তার চেয়ে লজ্জার ও উদ্বেগের আর কিছু হতে পারে না।
তিনি বলেন, আমরা এই ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স। যে কোনোভাবেই হোক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তি চাই, অপসারণ চাই এবং সমূলে উৎপাটন চাই। পরীক্ষা (ঘ-ইউনিট) বাতিল ও প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা চাই। কেবল যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা নয়, এর মূলহোতা যারা তাদেরকে খুঁজে বের করা হোক, বরখাস্ত করা হোক এবং শাস্তির আওতায় আনা হোক।
এর বাইরেও ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আন্দোলন হয়েছে। এ ঘটনায় আমারণ অনশনে বসেছিলেন এক শিক্ষার্থী।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, ছাত্রদল, সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাদা দল, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ দফায় দফায় কর্মসূচি পালন করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রশ্নফাঁসের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন লেখা দেখা গেছে।
সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা না নিতে পারায় ব্যার্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন থেকে। দাবি না মানলে কঠোর আন্দোলনেরও হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় প্রয়োজনে ‘বৃহত্তর সিদ্ধান্ত’র কথা ভাবছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এই সিদ্ধান্তে পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের মতো ব্যাপারও আসতে পারে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ঘ ইউনিটের পরীক্ষার বিষয়ে যে ধরনের অভিযোগ এসেছে আমরা তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছি। ইতিমধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আমরা কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছি। আগামীতেও যদি কোনো ‘বৃহত্তর সিদ্ধান্ত’ প্রয়োজন হয় আমরা নেব।’ ‘বৃহত্তর সিদ্ধান্ত’ পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবার মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্তও হতে পারে।’
প্রসঙ্গত, ১২ অক্টোবর শুক্রবার বেলা ১০টায় ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়। টানা তৃতীয়বারের মতো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটে সম্মান ১ম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
শুক্রবার বেলা ১০টায় পরীক্ষা শুরুর পূর্বে বেলা ৯টা ১৭ মিনিটে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়। বেলা ১১টায় পরীক্ষা শেষ হলে হাতে লেখা ওই উত্তরপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, সেখানে বাংলা অংশে ১৯টি, ইংরেজি অংশে ১৭টি, সাধারণ জ্ঞান অংশে ৩৬টিসহ মোট ৭২টি প্রশ্নের হুবহু মিল রয়েছে।
‘ঘ’ ইউনিটে বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান এ তিনটি বিষয়ে মোট ১০০টি প্রশ্ন থাকে। এ অবস্থায় পরীক্ষা বাতিল না করে ফলাফল প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ফলে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে অসংখ্য অসঙ্গতি। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সব মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে। দাবি উঠেছে পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার।