‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা’ কথাটা ভীষণ ক্লিশে; কিন্তু ছাত্র রাজনীতি থাকা না থাকা নিয়ে কথাটি মোটামুটি সবাই বলেন। আমি বলছি না। তবে আমি বলতে চাই কিছু জিনিস কেটে ফেলাই উচিত, যেমন ক্যান্সার। শনিবার (১৯ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, ক্যান্সার কেটে না ফেললে সেটা আপনাকে মেরে ফেলবে। প্রশ্ন হল ছাত্র রাজনীতি কি ক্যান্সার? যদি ক্যান্সার হয় তাহলে এটাকে কেটে ফেলা কি সমস্যার সমাধান করতে পারে?
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বুয়েটের ‘মেধাবীরা’ অন্যান্য দাবির সঙ্গে সেই দাবি করেছিলেন এবং সেই দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। এর জের ধরে এখন ছাত্র রাজনীতিই থাকবে না, অন্য সব জায়গায়ও নিষিদ্ধ হবে সেই তুমুল বিতর্ক সমাজে চলছে এখন। এ বিতর্ক আসলে নতুন নয়, প্রতিবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একেকটা খুন হয় আর ছাত্র রাজনীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
নাগরিকদের বড় একটা অংশ ছাত্ররাজনীতি বাতিলের পক্ষে কথা বলেন। কেউ বলেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থাকা চলবে না। কেউ আবার বলেন ছাত্র রাজনীতি হওয়া উচিত শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের সমস্যা এবং সংকট নিয়ে।
আসলেই কি ছাত্র রাজনীতি যদি থাকেও সেটা শুধু ছাত্রদের অভাব-অভিযোগ আর সংকট নিয়ে কথা বলবে? তারা কথা বলবে না রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাষ্ট্রীয় নানা বিষয় সম্পর্কে?
ধরে নেয়া যাক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হল সব জায়গায়। এ দেশের সরকারি দল তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তার দখলে রাখার চেষ্টা করবে না?
বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের শুরুটা এবং নেতৃত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রদের হাতেই হয়েছে। ফলে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর সাহায্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হলগুলোতে নিরঙ্কুশ দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পারলে সেটা সরকারবিরোধী ন্যূনতম প্রতিবাদও বন্ধ করে রাখতে পারে।
আজ হলে হলে যে টর্চার সেলের গল্প আমরা শুনি সেটা এ চেষ্টারই বহিঃপ্রকাশ। এ সহজ অঙ্কটা আমরা যারা বুঝি, তাদের সংশয় থাকার কোনো কারণ নেই, ছাত্র রাজনীতি ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিন্ন কোনো ফর্মে সরকারদলীয় ছাত্রদের আধিপত্য থাকবেই।
দেশের প্রশাসনের ভেতরে সরাসরি প্রকাশ্য রাজনীতির প্রশ্ন তো আসেই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো বিভিন্ন বর্ণের কর্মকর্তা নেই। কিন্তু তারপরও প্রতিটি সরকারের সময় ক্ষমতাশালী কর্মকর্তারা কি থাকেন না, যারা সরকারের বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে প্রশাসনে নানা রকম কাজ করে দখলে রাখেন প্রশাসন? এসব মানুষের বরং একটা দারুণ সুবিধা আছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির সব সুবিধা পাওয়া গেলেও দলের সঙ্গে থাকার কোনো দায় নিতে হয় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং অন্যসব অনিয়ম বিন্দুমাত্র কমবে না, বরং এখন যদি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ন্যূনতম দ্বিধাও তাদের মধ্যে থেকে থাকে সেটাও চলে যাবে।
আজ আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বা তার আগে বিশ্বজিৎসহ আরও সব বর্বর ঘটনায় আমরা ছাত্রলীগের দিকে যেভাবে আঙুল তুলতে পেরেছিলাম, ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতি না থাকলে সেটা সম্ভব হয়ে উঠবে না। মূল রাজনৈতিক দলগুলোও তখন ছাত্রদের সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের ক্ষেত্রে ভীষণ সুবিধা পেয়ে যাবে, বলবে অপরাধী ছাত্রদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এখন যেমন ছাত্রসংগঠনের অপরাধকারীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশ করেছে- এটি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে হয়, সেই কষ্ট আর থাকবে না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি খুব ভয়ংকর একটা রোগ হিসেবে ছিল; কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে এটা স্রেফ ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে, এতে আমার সন্দেহ নেই। ক্যান্সার কেটে ফেলাই উচিত। কিন্তু এ ক্যান্সার কেটে ফেলায় লাভ হবে না আদৌ।
ক্যান্সারের ধর্ম হচ্ছে ক্যান্সার শরীরের ভেতরে নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের কোথাও প্রাথমিকভাবে ক্যান্সার হলে সেটাকে বলা হয় প্রাইমারি ক্যান্সার। আর সেই ক্যান্সার থেকে ক্যান্সারের কোষ ছড়িয়ে পড়ে অন্য কোথাও ক্যান্সার তৈরি করলে সেটাকে বলে সেকেন্ডারি ক্যান্সার।
ছাত্রলীগের দুর্নীতি-অনিয়ম-বর্বরতা আসলে সেকেন্ডারি ক্যান্সার। প্রাইমারি ক্যান্সারটি হল মূল রাজনৈতিক দলের অনিয়ম-অসততা-দুর্নীতি-বর্বরতা। প্রাইমারি ক্যান্সার জিইয়ে রেখে সেকেন্ডারি ক্যান্সার কেটে কোনো লাভ হয় না। আবার নতুন করে সেকেন্ডারি ক্যান্সার তৈরি হবেই।
যারা ছাত্র রাজনীতির নানা সমস্যা সংকট দেখছেন, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্র কি দেখছেন না? বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলটি ভয়ংকর রকম ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এ দলের নেতারা বৃহৎ প্রকল্প থেকে, ব্যাংক থেকে, শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
যুবলীগের কয়েকজন নেতা ধরা পড়ার পর আমরা দেখেছি এমনকি সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের কাছে কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ-সম্পদ রয়েছে। বড়দের এভাবে ধন-সম্পদের ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেখে ছাত্রদেরও সেটা চাইবারই কথা।
ওদিকে ছাত্ররা দেখছে একটা কারণে তাদের মূল্য অন্য যে কোনো অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের চেয়ে অনেক বেশি- তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারবিরোধী আন্দোলনের বীজ ধ্বংস করে। ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা যখন বোঝে তাদের গুরুত্ব মূল সংগঠনের কাছে এতটা, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করে দলীয় লুটপাটের কিছু হিস্যা তারা পেতেই পারে।
ফলে তারা জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে। আর চর দখলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হল দখলের জন্য ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ওপর চরম নিপীড়ন চালায় তারা।
বাইরে থেকে কেউ ছাত্রলীগের সমালোচনা করতেই পারে। কিন্তু আমাদের এখানে ঘটছে অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি- স্বয়ং আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব ছাত্রলীগের সমালোচনা করছে। অর্থাৎ যে প্রাইমারি ক্যান্সারটির কারণে ছাত্রলীগ নামের সেকেন্ডারি ক্যান্সারটি তৈরি হয়েছে, তাকে সমালোচনা করছে সৃষ্টিকারী প্রাইমারি ক্যান্সারটি।
আমাদের সমাজের একটা অংশ মনে করেন ছাত্র রাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি হবে না এবং তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত হবে শুধু ছাত্রদের অভাব-অভিযোগ এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে। এ চিন্তার মধ্যেও ভ্রান্তি আছে।
আমরা কি মনে করি একজন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সার্বিকভাবে দেশের সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে সচেতন হবে না? এ ক্ষেত্রে তারা যদি সচেতন থাকে তাহলে তারা কেন সেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে না? বাংলাদেশের মতো একটা যথেষ্ট কম শিক্ষিতের দেশে সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা অনেক বেশি জরুরি।
এরশাদ পতনের পর থেকে একটা খুব কমন নিয়ম দেখা যায়- যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। মূল বিরোধী পক্ষের ক্যাম্পাসে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান থাকা তো দূরেই থাকুক, অনেক ক্ষেত্রে তারা ক্যাম্পাস বিশেষ করে হলছাড়া হয়ে থাকে।
ছাত্র রাজনীতির সংকটের পেছনে বরং ছাত্র রাজনীতির ওপর এক ধরনের সরকারি দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রধানত দায়ী। এ নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তুলে দিয়ে ক্যাম্পাসকে সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন হওয়া সম্ভব।
একইসঙ্গে দেশের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
কিন্তু এগুলোর কোনোটাই দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই পরিবর্তন হবে না, কারণ মূল দলগুলোর চরিত্রগত পরিবর্তন না হলে অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর চরিত্র বদলানোর কোনো কারণ নেই। তাই আমরা যারা সত্যিকার অর্থেই ছাত্র রাজনীতির সঠিক রূপ দেখতে চাই, তাদের উচিত হবে মূল রাজনীতিটাকে ঠিক করার জন্য চাপ অব্যাহত রাখা।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। কারও যদি মনে হয়, ছাত্র রাজনীতির বর্বরতার কারণে তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত, তাহলে তাদের দাবি হওয়া উচিত মূল রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, কারণ সেটাই এ নোংরা ছাত্র রাজনীতির জন্য দায়ী।
জাহেদুর রহমান : চিকিৎসক