শৈশবে আমাদের একজন বড় মাপের হিরো ছিল, ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট জেমস বন্ড। জেমস বন্ড ব্রিটেনের নিরাপত্তা সংস্থা এমআই সিক্সের একজন চৌকস গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি নিজ দেশকে বহিঃশত্রু থেকে নিরাপদ রাখার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এমআই সিক্সে তাঁর ক্রমিক নম্বর ছিল ০০৭। দেশের স্বার্থে মানুষ হত্যা করার জন্য তাঁকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় বেশ কায়দা করে বলতেন, ‘বন্ড, জেমস বন্ড’। লেখক ইয়েং ফ্রেলেমিংয়ের সৃষ্টি এই চরিত্র নিয়ে ১৯৬২ সালে প্রথম ছবি ‘ড. নো’ নির্মাণ করেন হ্যারি সেলসম্যান ও অ্যালবার্ট ব্রকোলি। বন্ড চরিত্রে অভিনয় করেন শন কনোরি আর নায়িকা উরসুলা অ্যান্ড্রুস। বন্ডের জন্য নির্মিত গাড়িটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা। ব্যবহার করেন বিশেষ রিভলবার। দেশের স্বার্থে করতে পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। সারা বিশ্বে ১৯৬২ সালে ‘ড. নো’ একযোগে রিলিজ হলে হৈচৈ পড়ে যায়। এটি হলো একজন ভালো বন্ড। বাংলাদেশে এখন আর এক ধরনের বন্ড তৈরি হয়েছে। দেশের কোনো নিরাপত্তা বা গোয়েন্দা সংস্থা এদের তৈরি করেনি। করেছে পরিবার, সমাজ আর দেশের নষ্ট রাজনীতি। তেমন একজন বন্ড নয়ন বন্ড, যার কথা এরই মধ্যে দেশের সব মানুষ জেনেছে। কিন্তু কোনো ভালো কাজের জন্য নয়, সে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে তারই সমবয়সী একজনকে হত্যা করেছে। ঘটনাটি ঘটে বরগুনা জেলায় গত ২৬ জুন। আগে মানুষ খুন করত আড়ালে-আবডালে। এখন খুন হয় সবার সামনে, দিনের বেলায়। শুধু খুন নয়, মা-বাবা, স্বামী বা সন্তানের সামনে স্ত্রী-কন্যাকে ধর্ষণ করে এই নষ্ট বন্ডরা। শিক্ষার্থীর গায়ে প্রকাশ্যে দিবালোকে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে হত্যাচেষ্টা করতে এদের হাত কাঁপে না। যারা করে তারা নিজেদের হিরো মনে করে। ধরে নেয় এসব করলে কিছু হবে না। তাদের বাঁচানোর জন্য বড় ভাইরা আছেন। রোববার (৭ জুলাই) কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন আবদুল মান্নান।
বরগুনার ঘটনাটি গত ২৬ জুনের। ২২ বছরের রিফাত শরীফ তাঁর স্ত্রী মিন্নিকে নিয়ে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সকাল ১০টা ৩০ মিনিট। হঠাৎ করে এই যুগের নয়ন বন্ড তার বন্ধু নিশান ফরাজী আর রাব্বি আকনকে নিয়ে রিফাত ফরাজীকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে শুরু করে। রিফাতের স্ত্রী মিন্নি খালি হাতে তাঁর স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু সশস্ত্র বন্ড গংয়ের সামনে মিন্নি খালি হাতে কী-ইবা করতে পারেন? চেয়ে চেয়ে স্বামীর মৃত্যুর সাক্ষী হলেন। ঘটনার সময় অনেকে তা দেখলেও কেউই হতভাগা রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। কি জানি বাবা কিসের থেকে কী হয় চিন্তা সবার মাথায়। জানা গেছে, ঘাতক নয়নের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয়েছিল, যা টেকেনি। পরে মিন্নি রিফাতকে বিয়ে করে। সমাজে এসব ঘটনা আকছার ঘটে কিন্তু তার প্রতিশোধ নিতে একেবারে প্রকাশ্যে দিবালোকে খুনখারাবি তেমন একটা দেখা যায় না। পুলিশ ক্লোজ সার্কিট টিভির ফুটেজ দেখে নয়নকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গত ২ জুলাই নয়ন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়। নয়ন নাকি একসময় ছাত্রদল করত। এখন সরকারদলীয় সদস্যদের সঙ্গে তার মাখামাখি বেশ। ঘটনা যা-ই হোক নয়ন বন্ডদের এসব বোঝার ক্ষমতা নেই যে আসল বন্ড দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত না হলে কাউকে খুন করে না, যদিও তার খুন করার লাইসেন্স আছে। নয়ন বন্ড এই সমাজের অনেক নষ্ট রূপের একটি। এমন নয়ন আছে অসংখ্য।
এই নয়নরা কেউই নষ্ট হয়ে জন্ম নেয় না। পরিবার, সমাজ আর দেশের নষ্ট রাজনীতি এদের সৃষ্টি করে। নয়ন হতে পারত একজন বিজ্ঞানী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, প্রশাসক অথবা একজন জনবান্ধব রাজনীতিবিদ। সে সম্ভাবনা সব মানুষেরই থাকে। কিন্তু বর্তমান সমাজে নয়ন বন্ড হওয়ার রাস্তা অনেক ও সহজ। একবার সেই রাস্তায় গেলে আর ফেরার উপায় থাকে না। এই রাস্তা থেকে ফেরানোর প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারের। কোনো পরিবারে শৃঙ্খলা না থাকলে সেই পরিবারের যেকোনো তরুণ বা তরুণীর উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সেই তরুণ বা তরুণী তার মতো উচ্ছৃঙ্খল তরুণ-তরুণী খোঁজে বন্ধু বানানোর জন্য। তারা মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শেখে না। এ ব্যাপারে পরিবারের কোনো মাথাব্যথা নেই। ছেলে আর বাবা একসঙ্গে বসে মদ বা সিগারেট খাওয়াকে আধুনিকতা মনে করা হয়। মায়ের সামনে রাতবিরাত ছেলেবন্ধুকে নিয়ে পার্টিতে যাওয়া এখন একটি ফ্যাশন এক শ্রেণির শহুরে পরিবারের কাছে। সন্তানের কাছে দামি মোবাইল না থাকলে অনেক মা-বাবা অপরাধবোধে ভোগেন। নয়নদের পাড়া-মহল্লার মানুষ ভয় করে আবার কাজেও লাগায়। কারো জমি দখল করতে হবে নয়নদের খবর দাও। কোনো বস্তিতে আগুন দিতে হবে সমস্যা নেই। নয়ন ভাইরা আছে না! দরদাম করো। তারপর কাজ আদায়। হত্যা, গুম তা তো নয়নদের বাঁ হাতের খেল।
তবে নয়নদের বেশি কদর কালো টাকার মালিক আর উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিড রাজনীতিবিদদের কাছে। বঙ্গবন্ধু বা জাতীয় চার নেতার কাছে কোনো নয়ন ছিল না। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ওহাব মিয়া নিজ হাতে জমি চাষ করতেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন। মাঠের চাষ অন্যকে দিয়ে সংসদে যোগ দিতেন। নিজের টাকা ছিল না বলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওহাব মিয়ার বাড়িতে টেলিফোন বসেছিল। সেই যুগ পাল্টে গেছে। এখন রাজনীতিবিদরা তথাকথিত ছাত্র বা যুবনেতারা দুই পাশে ডজনখানেক নয়ন নিয়ে চলাফেরা করেন।
এক বিমানবন্দরে বিমানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় একজন নাবালক সংসদ সদস্য ভিআইপি কক্ষে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে গোটা দশজন নয়ন। এই নয়নদের দাপটে অনেকে এলাকা ছাড়া। বিয়েশাদি বা কোনো অনুষ্ঠান করতে হলে আগে নয়নদের খুশি করতে হবে। সেদিন আমার একজন সাবেক ছাত্র, যিনি সংখ্যালঘু, এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আমাকে বলছিলেন, তাঁদের এলাকার নয়নদের মাসোয়ারা দিতে হয় তাঁদের বাড়ি আর মন্দির পাহারা দেওয়ার জন্য। এমন অবস্থা ভারতের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের। আমার এক পরিচিতজন জায়গা কিনেছেন কিন্তু বাড়ি করতে পারছেন না। কারণ তাঁদের এলাকার নয়নদের দাবি মেটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে নয়ন বন্ড সংস্কৃৃতি শুরু করেছিলেন সেনা শাসক জিয়া। যেহেতু তাঁর কোনো গণভিত্তি ছিল না, সেহেতু তাঁকে নতুন নয়ন সৃষ্টি করে তাদের ওপর ভর করতে হয়েছে। মেধাবী ছাত্র অভি, নিরু, বাবলু আর পিন্টুকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধারা তাঁর স্ত্রী বেগম জিয়াও লালন করেছেন। এখন ওই নয়নরা বেপরোয়া। বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলেই প্রবেশ করেছে। কারণ মনে করা হয় সরকারি মানুষের সঙ্গে থাকলে লাভ বেশি। আমাদের সময়কার ছাত্রনেতারা যেমন তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন বা নূরে আলম সিদ্দিকি পায়ে হেঁটে বা রিকশায় বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কোনো সভায় আসেন। এখন নিজস্ব গাড়ি নেই, তেমন ছাত্রনেতা তো দেখি না।
একজন নয়ন তো ক্রসফায়ারে গেল, কিন্তু ঘরে ঘরে থাকা নয়নদের কী হবে? এই নয়নদের শেষ যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ দেশ, সমাজ আর পরিবারের কোনো স্তরেই শান্তি আসবে না। নয়নদের আঁতুড়ঘর পরিবার। শুরুটা হতে হবে পরিবার থেকে। পরিবার শুধু আঁতুড়ঘর নয়, একজন বেড়ে ওঠা মানুষের প্রথম পাঠশালা। তার প্রথম শিক্ষক তার মা-বাবা। তাঁদের ওপরই প্রথম দায়িত্ব বর্তায় বাড়ির সন্তান ভালো নয়ন হবে না নষ্ট নয়ন হবে। সমাজও তার দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। আমাদের সময় সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের একটা মর্যাদা ছিল। পাড়ার স্কুল বা ক্লাবে কোনো অনুষ্ঠান হলে তার প্রধান অতিথি হতেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কোনো একজন মুরব্বি। এখন সেই সংস্কৃতির বদলে প্রধান অতিথি হন একজন বড় ভাই বা উঠতি রাজনীতিবিদ। তাঁদের একজনকে প্রধান অতিথি না করলে অনুষ্ঠানই ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। এরপর আসে উড়ে এসে জুড়ে বসা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কথা, যারা উত্থান পর্বে নষ্ট নয়নদের কদর বেড়ে যায় বহুগুণ। নয়নদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় বহুগুণ। এরা রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী বা পাতিমন্ত্রী, উঠতি মন্ত্রী, হবু মন্ত্রী হতে পারে। মন্ত্রীদের অবর্তমানে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে, তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। এদের প্রধান কাজ হচ্ছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস সৃষ্টি, পাড়ার কলেজ বা স্কুলগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা অথবা দিনভর রকবাজি করা। তারপর নয়নদের নষ্ট রাজত্বকাল শুরু হয়। তখন নয়নদের হাতে দিনের বেলায় নিহত হয় রিফাত শরীফ বা অন্য কেউ। ধর্ষিত হয় কারো স্ত্রী, কন্যা বা বোন। এই নয়নদের কিছু হয় না। পুলিশ অনেক কষ্টে হয়তো এদের গ্রেপ্তার করে কিন্তু তাদের বেশিদিন আটক রাখা সম্ভব হয় না। কারণ তাদের লালনকর্তারা পুলিশের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর। পুলিশ অনেক সময় বাধ্য হয় একটি দুর্বল চার্জশিট দিতে, যার বদৌলতে আদালত থেকে নয়নরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। আবার অনেক সময় পুলিশ হয়তো যথাযথ চার্জশিট দেয়। কিন্তু আদালতে মামলা উঠলে কেউ সাক্ষ্য দিতে আসে না। তাদেরও পরিবার-পরিজন আছে তো। নয়নরা ফিরে আসে সগৌরবে। উঠতি নয়নরা স্লোগান তোলে ‘নয়ন ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’। এ রকম নয়নদের দৌরাত্ম্য এখন সীমাহীন। তাদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এমনটি চলতে থাকলে প্রথমে ভেঙে পড়বে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা, তারপর রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র। রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে শিকড়বিহীন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতে। বর্তমানে দেশের রাজনীতির চাবিটা এখনো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে। তাঁর অবর্তমানে কী হবে তা চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। তখন বাংলাদেশ হয়ে যেতে পারে আফ্রিকার কোনো এক পতিত রাষ্ট্র—যেমন সোমালিয়া বা আইভরি কোস্ট। উজাড় হোক কম্বল, লোম বাছার এখনই সময়। তা না হলে পুরো জাতিকে পস্তাতে হবে।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক