অকস্মাৎ ঝড়ের মতো কিছু সংবাদ আমাদের দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যায়। সম্ভাবনাময় স্বপ্নটি যদি মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে বিপরীতার্থ বহন করে, শুধু তখনই আমরা নড়েচড়ে বসি। বিশ্ব মহামারীর এ চরম সংকটময় মুহূর্তে বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রস্থান তেমন একটি ঝড়ো হাওয়ায় আমাদের চেতনাভূমি ও সমাজ বাস্তবতাকে টলটলায়মান করে দিয়ে গেল। সম্প্রতি হৃদযন্ত্রের যে স্বাভাবিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁর পরিণতি যে আমাদের এতটা মূল্য দিয়ে গুনতে হবে, কখনো ভাবিনি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর অবস্থার উন্নতির সংবাদে তাঁর শুভাকাক্সক্ষী ও অনুরাগীরা প্রাণ ফিরে পেলেন যে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও চেতনার বিশুদ্ধতার অভিভাবক আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসছেন। এর মাত্র দু’দিনের মাথায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যখন তিনি আরও সুস্থতার জন্য গেলেন, সেখান থেকেই তাঁর মহাপ্রস্থান আমরা মেনে নিতে পারিনি। যাকে অসীম মূল্য দিয়ে ধরে রাখতে চাই, যাকে প্রগাঢ় ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে রাখতে চাই- সেই তিনিই যখন আমাদের সব স্বপ্নকে চুরমার করে চুপ হয়ে যান; তাঁর নিস্তব্ধতা তো পাহাড় প্রমাণ ভার হয়ে আমাদের হৃদয়ে বাজে। শনিবার (১৬ মে) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, যে কোনো সময়ে-অসময়ে আমরা যখন তাকে নির্ভর করেছি, আশ্রয় করেছি, সম্ভাবনার স্ফুরণ দেখবা বলে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছি; সেই তিনিই আর কোনোদিন কথা না বলার ব্রতে হয়ে গেলেন চিরঅভিমানী। যার কোনো বিকল্প হয় না, যার কোনো দ্বিতীয় হয় না, তেমন একজন অকৃত্রিম বাঙালি আমাদের ছিলেন, তেমন একজন অহংকার আমাদের ছিলেন, তেমন একজন আলোর প্রদর্শক বাঙালি জাতির ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আন্দোলন-সংগ্রামকে দীর্ঘ চুরাশিটি বছর ধরে শাণিত করেছেন, এর চেয়ে পরম সৌভাগ্য আর আমাদের কী হতে পারে! আজ তাই তাঁর প্রস্থানে শোকাকুল সমগ্র বাঙালি জাতি, বাংলার আকাশ-বাতাস-অরণ্য-সমুদ্র-নদী।
কোনো কোনো দিনে আকাশজুড়ে প্রচ- মেঘ করে এলে দিনের আলো তাঁর উজ্জ্বলতা হারায়। ধারণ করে অনেকটা সান্ধ্যমূর্তি। সূর্যের অস্তিত্ব বলতে কোথাও কিছু থাকে বলে মনে হয় না। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সেই মেঘলাদিন কিন্তু কখনো রাত্রিতে রূপান্তরিত হয় না। কোথাও না কোথাও থেকে দিনের সূর্যের আলোকরশ্মি এ পৃথিবীতে এসে একটু হলেও দিনের সম্মান বাঁচিয়ে রাখে। তাই আকাশে যতই মেঘ ঘনিয়ে আসুক না কেন, তা কখনো দিনকে রাত্রিতে রূপান্তরিত করতে পারে না। ঠিক এমনিভাবে এমন কিছু কিছু সত্যিকারের জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক মানুষ থাকেনই, যারা জাতীয় জীবনে চরমতম অন্ধকার ঘনিয়ে আসার মুহূর্তেও কোথাও না কোথাও বসে তাদের জ্ঞান ও প্রেমের আলো দিয়ে অন্ধকারকে আলোকিত করতে সদা তৎপর থাকেন। বাঙালি জাতির জীবনে তেমন একটি জ্ঞানাগার ছিলেন আনিসুজ্জামান। তেমন একজন সংবেদনশীল দেশপ্রেমিক-ঐতিহ্যপ্রেমিক নাগরিকের নাম আনিসুজ্জামান।
যতটা আঁচ করতে পারি, আনিসুজ্জামান শুধু একজন ব্যক্তিমাত্র তো ননই, নন একক কোনো উচ্চমাত্র অভিধার কেউ। একটি দুটি বা ততোধিক বিশেষণে সম্বোধিত করেও তাঁকে সত্যিকারের মূল্যায়ন করা যায় না। হ্যাঁ, প্রতিটি জাতিতে বিরল কিছু মানুষ তাদের স্বতন্ত্র মনুষ্যত্ব নিয়ে উপস্থিত থাকেন, যারা এমনভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে যান যে, তাদেরকে আর বিশেষ কিছুতে আটকে রাখা যায় না। তাদের মনের অজান্তেই হয়ে ওঠেন সর্বত্রের। তখন তাদেরকে ভাবা যায় অন্ত্যজের, সাধারণের, এলিটের, পেশাজীবীর, খেলোয়াড়ের, ভিক্ষুকের, ছাত্র-শিক্ষকের, সৃষ্টিশীলের, বুদ্ধিজীবীর, রাজনীতিবিদের কিংবা সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনার কিংবা আরও অনেক কিছুর।
ধারণা করি, আনিসুজ্জামান তেমন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া একজন মানুষ। একজন মানুষ যতটুকু উঠতে চান, কিংবা উঠতে পারেন, সে জায়গাটুকু তো সসীমই। কিন্তু মানুষ যখন তার লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, তখন আর তাকে সসীমে আটকে রাখা যায় না। তিনি নিজেই তখন হয়ে ওঠেন অসীমের। সেই অসীমের যে সুখ তাকে সুখী করতে প্রস্তুত; তারও কয়েকগুণ বেশি দুঃখ ও অপ্রাপ্তি তাঁকে নিভৃতে ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত করে রাখে। তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকে পত্রহীন শাখা, চেতনাহীন শিক্ষা, অন্নহীন মানুষ, পথহারা পথিক, দিশাহীন জাতি এবং আরও কতকিছু। তখন মনের অজান্তে তাঁর মধ্যে এ কর্তব্যবোধ জেগে ওঠে যে, এদের প্রত্যেকের মুখে হাসি না ফুটিয়ে তিনি সুখনিদ্রায় রাত্রি কাটাতে পারেন না। প্রতিটি জাতির মধ্যে এমন কিছু আলোকালয় ব্যক্তিত্ব থাকেন; যারা কেউ চাপিয়ে না দিলেও এই কর্তব্যবোধ অনুভব করেন এবং সুদূরে দৃষ্টি দিয়ে এটা দেখতে পান যে, ওই অনালোকিত স্থানগুলোতে শেষ আলো ফেলবার ভরসা শুধু তাদের জন্যই অবশিষ্ট আছে। সেখানে নেতা, রাজনীতিক, শাসক, বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবী কিংবা অন্য নির্ভরতার মুখগুলো যখন তাদের দায়িত্ব ফেলে চলে গেছেন, তখন একমাত্র সত্যিকারের দেশপ্রেমিক আলোকিত মানুষটিকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন তাঁর বুকে চেপে বসা অনিশ্চয়তা আর দুর্লঙ্ঘ্য পথের অসহযোগিতা তাঁকে ব্যথিত করে, তাঁকে ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আলোতেই উৎস রচনা করে বিজয়ের হাসি।
এমন একজন আলোকিত মহৎপ্রাণ মানুষ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে তাঁর মতো একজন মানুষ আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে আলোর দিকে টেনেছেন, নিজে সেই আলোকায়নের পথের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে। যতদিন সুস্থতা অনুভব করেছেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, সকাল-বিকাল-রাত্রি- জ্ঞান আর দেশপ্রেমের সূর্যকণা হাতে চষে বেড়িয়েছেন।
আমরা সবাই জানি যে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে স্তরে দাঁড়িয়ে আমাদের মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, তা একদিনে তৈরি হয়নি। সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়, যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর, তখনই তিনি তাঁর আবির্ভাব জানান দিয়েছিলেন। তার পর থেকে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণাকালে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাঙালির যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা এ স্বাক্ষর রেখেছে। দেশে সামরিক স্বৈরশাসকের আমলে, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থানের কালে তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত অনমনীয় ভূমিকা জাতিকে অন্ধকার ডিঙিয়ে আলোর দিকে টানতে উৎসাহিত করেছে।
সত্যি বলতে কি, আজকের দিনের কোনো কোনো তারুণ্যের মধ্যে, বিপ্লবীদের মধ্যে যে সাহসের অভাব পরিলক্ষিত হয়; যে দৈন্য ও আলস্য ভর করেছে; তখন অশীতিপর আনিসুজ্জামানের ভূমিকা যেন তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের স্তরে এসে ঠেকেছিল। দেশব্যাপী যখন মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের ভয়াল বিস্তার মানুষের বেঁচে থাকাকে অনিশ্চিত করে তুলেছিল; ৬৪ জেলায় বোমা হামলা করে প্রকম্পিত করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাকে; উদীচী-রমনার মতো যত্রতত্র বোমা হামলা করে হত্যা করা হয়েছিল অগণিত মানুষকে; যুদ্ধাপরাধীরা যখন স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে পবিত্র সংসদ ও দেশের মাটিকে কলঙ্কিত করেছে; তখন আনিসুজ্জামানের মতো মানুষকে দেখা গেছে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে কী করে জাতিকে রক্ষা করা যায়, স্বাধীনতার মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া যায়, সেদিকে আমাদের নির্দেশনা দিতে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত তিনি রাখলেন প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে একজন কুখ্যাত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে। ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে এ রাজাকাররা যখন প্রচ- বেয়াড়া, একরোখা, ক্ষ্যাপাটে হয়ে মানুষ হত্যা করছে; ঠিক সেই মুহূর্তে আনিসুজ্জামানের মতো সর্বপরিচিত একজন বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদের কুখ্যাত রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে কথা বলাকে কোনোভাবে সহজ ভাববার সুযোগ নেই। এ যেন বাঙালি জাতির ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকার মতো বিরল ঘটনা।
আমাদের অসামান্য অভিভাবক আনিসুজ্জামান শুধু সময়ান্তরে আমাদের কাছে এক মহীরুহ হয়ে ওঠেননি; আশৈশব তাঁর বেড়ে ওঠার ইতিহাস, পারিবারিক আবহ এক্ষেত্রে যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি তাঁর লেখাপড়া ও জানার প্রতি আগ্রহ তাঁকে লক্ষ্য অর্জনে অনেক বেশি অগ্রসর করে দিয়েছে। তিনি শুধু দেশ-বিদেশে লেখাপড়া শেখা একজন সাধারণ মেধাবী শিক্ষকমাত্র হয়ে থাকতে চাননি। নিরন্তর সৃষ্টিশীলতা ও শিক্ষার মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। এ প্রমাণ আমরা তাঁর লেখালেখিতে যেমন লক্ষ্য করি, তেমনি তা স্পষ্ট হয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে। বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গ্রন্থগুলো সম্পাদনা করেছেন- আনিসুজ্জামানের মেধাজাত সেইসব বিষয়ের ওপর আলো ফেলার মতো দ্বিতীয় কাউকে তো চোখে পড়ে না। বরং বিস্মিত হতে হয় তিনি সত্যি সত্যি কী বিচিত্র বিষয়কে ধারণ করে বড় হয়েছেন! কী বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন! জ্ঞানের জন্য, নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে তিনি কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করে গেছেন!
তাঁর কিছু একক ও যৌথ সম্পাদিত বইয়ের কথা বলি- যা আমাদের চিরকালের সম্পদ হয়ে আছে : রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ, অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ, নারীর কথা, মধুদা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, স্বরূপের সন্ধানে, পুরনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, বিপুলা পৃথিবী, কাল নিরবধি, Factory correspondence and other Bengali Documents in the India office Library and Records; Creativity, Identity and Reality; Cultural Pluralism; Identity, Religion and Recent history; SAARC : A People’s Perspective প্রভৃতি।
আনিসুজ্জামান সাহিত্য ও সংস্কৃতিসাধক ব্যক্তিত্বদের গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজেকে এমন স্থিতধী করে গড়ে তুলতে পেরেছেন। অসংখ্য গুণী সংস্কৃতিবান ব্যক্তিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণধর্মী লেখার মাধ্যমে তাঁদের মূল্যায়নের প্রমাণ বিভিন্ন গ্রন্থে রেখেছেন। শুধু ব্যক্তিত্ব নয়; ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে বিষয়ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। যেমন কিছু কিছু বিষয় আছে, যা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ব্যক্তি সেখানে স্বভূমিকায় তাঁর স্থানে অধিষ্ঠিত থাকেন। যেমন আমাদের বায়ান্নার ভাষা সংগ্রাম, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ও ছিয়ানব্বইয়ের অসহযোগ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়া আছে পৃথিবীব্যাপী কিংবা আমাদের বিভিন্ন নিজস্ব সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এ জাতীয় বিষয় যেমন তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণে বিশ্লেষিত হয়েছে; তেমনি নতুন নতুন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছেন গণমানুষের পক্ষ হয়ে; তাদের অবস্থানে দাঁড়িয়ে।
লেখক ও অভিভাবক আনিসুজ্জামানের যে বিষয়টি সবার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সামনে উঠে এসেছে; তা হলো- তিনি মানুষের চেতনার ও বুদ্ধিবৃত্তির উপেক্ষিত এলাকাগুলোকে শনাক্তকরণে তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতায় আলো ফেলেছেন নিরন্তর। সেটা তাঁর বক্তৃতা, লেখা, আড্ডা-অন্তরঙ্গতায়ও প্রমাণিত হয়েছে। আজ তাই সমাজের সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে কখনো কখনো হয়ে পড়েছিলেন একক নির্ভরতা। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্ব খুঁজতে গেলে তাঁর বিকল্প মেলাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একইভাবে তিনি তাঁর লেখনিকে চালনা করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিমা ও যুক্তিনিষ্ঠতায়। অতিকথন ও বাহুল্যহীনতা তাঁর লেখার অন্যতম বিশিষ্টতা। খুব স্বল্প পরিসর ও অল্প কথায় তিনি ব্যাপক বিষয়কে ধারণ করতে পারঙ্গম। তাঁর জীবন ও বিচরণ এতটাই ঘটনাবহুল ও সামগ্রিক যে, যে কোনো বিষয় লিখতে গেলেই তিনি সেখান থেকে রসদ নিতে পারতেন, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে অব্যর্থ যুক্তিতে লেখার পরিণতি টানতেন। তাঁর রচনার আর একটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে : বিষয়ভিত্তিক রচনাগুলোতে তিনি তাঁর জীবন কিংবা ইতিহাস থেকে এমন একটি উদারহণ খুঁজে বের করেন যেন ওই লেখাটি সম্পূর্ণ করতে এই উদাহরণটির কোনো বিকল্প নেই। এবং তেমন একটি উদাহরণের মাধ্যমে তিনি খুব অল্প কথায় একটি বিস্ময়কর রচনা দাঁড় করান। এক্ষেত্রে তাঁকে একটি জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া বললে অত্যুক্তি হয় না।
আমাদের এই অভিভাবক আনিসুজ্জামান, যে কোনো জাতির জন্য এমন একজন আনিসুজ্জামান নিঃসন্দেহে ক্ষণজন্মা হয়ে আবির্ভূত হন। এমন মানুষের প্রাপ্তি যে কোনো জাতির জন্য বিরল সৌভাগ্যের। যে মানুষটি জীবনে কখনো নিজেকে ফাঁকি দেননি; একটি মুহূর্তও অপব্যয়িত হতে দেননি; একটি ক্ষণও জ্ঞানের আলোহীন পথ হাঁটেননি, তিনি আনিসুজ্জামান। ৮৪ বছরের জীবনে যে বিশাল সৃষ্টিসম্ভার, উপদেশ-নির্দেশনা ও সত্য প্রকাশের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন; তাকে অতিক্রম করা যে কারোমাত্র কাজ নয়। এমন ললাট লিখন শুধু কোনো সৌভাগ্যবান জাতিরই থাকে। আজ তাঁর চিরপ্রস্থান যেন বাঙালির ভ্যাগ্যাকাশ চিরে অসহায়ত্বের তুমুল বর্ষণ।
লেখক : ওবায়েদ আকাশ, কবি, সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ