আমলাদের অদক্ষতা ও গাফিলতির কারণে ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ’ প্রক্রিয়া থমকে গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় না করে আট শতাধিক সরকারি ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি’ চালু করে বেকায়দায় পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অবকাঠামো বৃদ্ধি ও শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর চালু করে ‘তালগোল’ সৃষ্টি করা হয়েছে আট শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওইসব বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাঠদানের জন্য ওইসব বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নেই। নতুন করে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগও নেয়া হয়নি। এছাড়া পাঠদানের পরিধি বাড়লেও অফিস সহকারী ও দপ্তরি নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে ওইসব স্কুলে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে (৬ষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি) পাঠদান কার্যক্রমে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন ও সৈয়দ কামরুজ্জামান।
প্রতিবেদনে জানা যায়, এদিকে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর চালু হওয়ায় ওইসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও বন্ধ রয়েছে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ওইসব স্কুলের কোনো ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তি পাচ্ছে না। এতে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু মানেই বিদ্যালয়টি নিম্ন মাধ্যমিক। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান জনবল কাঠামো অনুযায়ী, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিক্ষক ও প্রতি শ্রেণির জন্য একজন করে মোট ছয়টি শিক্ষকের পদ রয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক, দফতরি ও অফিস সহকারীর কোনো পদ নেই। অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও ওই তিন শ্রেণির জন্য ন্যূনতম একজন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়নি। দপ্তরি বা অফিস সহকারীর পদ সৃষ্টিরও কোনো তৎপরতা নেই।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) একজন প্রধান শিক্ষকসহ মোট ৯টি শিক্ষকের পদ রয়েছে। এখানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত/বিজ্ঞান, ইসলাম ধর্ম, সমাজ বিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং শরীর চর্চা বিষয়ে শিক্ষকের পদ রয়েছে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস।
এছাড়াও বর্তমানে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন অফিস সহকারী ও একজন দপ্তরির পদ রয়েছে। তবে বালিকা বিদ্যালয়ে দু’জন দফতরি থাকে। নতুন জনবল নীতিমালা অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরির পদ আরেকটি বেড়েছে।
জানা গেছে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’র আলোকে পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ধাপে ধাপে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়। এর মধ্যে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫১৬টি এবং ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানে নিম্ন মাধ্যমিক চালু করা হয়। সবমিলিয়ে এ সংখ্যা আট শতাধিক।
শিক্ষানীতি অনুযায়ী, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করা কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সব বিদ্যালয়ে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর চালুর চিন্তাভাবনা করছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘অবকাঠামো বা শিক্ষক সংকট সমস্যা নয়। মূল সমস্যা হলো- আমলাতন্ত্র এবং দুই মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও সদিচ্ছার অভাব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রাথমিকে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি চালু হলে তাদের ঝামেলা বাড়বে। আর গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করছে, তাদের কর্তৃত্ব কমে যাবে, সব নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যাবে। এজন্য তারা শিক্ষক ও অবকাঠামো সমস্যার নামে কাজটি ঝুলিয়ে রেখেছেন।’
সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত। পঞ্চম শ্রেণীর ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’ নেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর ৬ষ্ঠ থেকে ওপরের স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম দেখভাল করার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের; কিন্তু এ মন্ত্রনালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের দায়িত্ব নিচ্ছে না। এর ফলে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই তিন স্তর অব্যাহত রাখতে পারছে না; বন্ধও করতে পারছে না।
সরাইল থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, নতুন শিক্ষাবর্ষে উপজেলার ধামরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ১০০ সেট, সপ্তম শ্রেণির জন্য ৬০ সেট ও অষ্টম শ্রেণির জন্য ৫০ সেট পাঠ্যবই সরবরাহ করা হয়েছে। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। আর ধর্মতিত্ত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ১০০ সেট, সপ্তম শ্রেণির জন্য ১০০ সেট ও অষ্টম শ্রেণির জন্য ৯০ সেট পাঠ্যবই সরবরাহ করা হয়েছে।
যদিও ধর্মতিত্ত্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দুর্ঘাচরণ দাস বলেন, ‘৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়ানোর জন্য শিক্ষক নেই; অবকাঠামো নেই। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ে সংস্কার কাজও হচ্ছে না। এতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এরপরও বিদ্যালয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাসের হার প্রায় ১০০ ভাগ।’
গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করতে হলে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, জনবল, ব্যবস্থাপনা- সব কিছুই নতুন করে সাজাতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে স্নাতক ও বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আলোকে জাতীয় বাজেটে আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এর ফলে ওইসব বিদ্যালয়ে বর্ধিত শাখার জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। জমি ক্রয় ও অবকাঠামোও সম্প্রসারণ করতে পারছে না গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ‘আমি আশা করি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে যে জটিলতা রয়েছে সেটি ওভারকাম (সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা) করতে পারব। এই নীতিটি সরকার করেছে; একটু সময় লাগলেও সেটি অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে পারব।’
ডিপিই’র একাধিক কর্মকর্তা জানান, নিম্ন মাধ্যমিক স্তর চালু হওয়া বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের জন্য পৃথক কমনরুম নেই। আসবাবপত্র যেগুলো রয়েছে, সেগুলো নিম্নমাধ্যমিক স্তরের ছেলেমেয়েদের বসার উপযোগী নয়। খেলাধুলার জায়গাও সীমিত।
দেশে ৬৩ হাজার ৮৬৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যালয় ৩৭ হাজার ৬৭২টি ও ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারিরণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৫ হাজার ২৪০টি এবং পরীক্ষণ বিদ্যালয় ৫৫টি। এছাড়া বিদ্যালয়বিহীন গ্রামগুলোতে একটি করে এক হাজার ৫০০টি নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এগুলোসহ মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার।