ডিভোর্সি পিতা-মাতা। প্রায় ১০ বছর ধরে তারা আলাদা। তখন তাহমিদ, ওয়াহিদ ও তৌহিদের বয়স কম। শিশুবয়সী ছিলেন তারা। কিছুই বুঝেননি। বিচ্ছেদের পর থেকে মায়ের সঙ্গে সিলেট শহরেই তাদের বসবাস। এখন তারা স্কুল, কলেজে পড়ে। জীবন লড়াইয়ে তিন ভাই খুঁজে ফিরে শৈশব। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ওয়েছ খছরু।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিন্তু সেই সুযোগ তো আর নেই। একটু সুখের আশায় পিতার সম্পত্তিই তাদের শেষ ভরসা। গত ৯ই অক্টোবর তারা তিন ভাই শহর থেকে মালপত্র নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু নানা নাটকীয়তার পর তাদের থানায় ধরে নিয়ে করা হয় অকথ্য নির্যাতন। এরপর চুরির মামলা দিয়ে তাদের আদালতে পাঠায় পুলিশ। ছোট ভাইকে নিয়ে তিন দিন কারাবাসের পর মুক্ত হয়ে তাহমিদ হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী। যতটা ক্ষোভ তার চাচা কিংবা স্বজনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ তার পুলিশের বিরুদ্ধে। তিন জনের বয়স ১৮ থেকে ২২’র মধ্যে। কিন্তু থানা হাজতে নির্দয়ের মতো তিন ভাইকে পেটায় পুলিশ। এসব ঘটনা জানিয়ে সম্প্রতি সিলেটের পুলিশ সুপারের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েছেন তাহমিদ। জানিয়েছেন, ‘আমরা তিন ভাই ছাত্র। স্কুল কিংবা কলেজে পড়ি। আমাদের ওপর এমন নির্যাতন করা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি। হাজতে যখন পুলিশ লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল তখন আমি ছোট দুই ভাইকে নির্যাতন থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। এরপরও মন গলেনি পুলিশের।’
ওই তিন সন্তানের পিতা বিয়ানীবাজারের মেওয়া গ্রামের মাহমুদ আহমদ চৌধুরী। মা রুমা বেগম সিলেট নগরীর উপশহরের একজন ব্যবসায়ী। নারী উদ্যোক্তাও তিনি। রুমা বেগম জানিয়েছেন, স্বামীর আত্মীয়স্বজনের কারণেই তার সংসার করা হয়নি। তার স্বামী মাহমুদকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে স্বজনরা ১৪ বছর আগে ডিভোর্স দিতে বাধ্য করেন। এরপর থেকে তিনি তিন সন্তানকে নিয়ে সিলেট নগরীর উপশহর এলাকায় বসবাস করছেন। মাহমুদ আহমদ চৌধুরী ডিভোর্সের পর আর বিয়ে না করলেও তিনি তার তিন সন্তানের খোঁজখবর রাখেন। গত ১৭ই অক্টোবর সিলেটের পুলিশ সুপার বরাবর দেয়া আবেদনে মাহমুদ ও রুমার সংসারের বড় ছেলে তাহমিদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি দক্ষিণ সুরমা কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ভাইদের নিয়ে মায়ের সঙ্গে সিলেট শহরে বসবাসের সুবাদে বিয়ানীবাজারের মেওয়া গ্রামের পৈতৃক সম্পত্তি তার চাচা মকসুদ আহমদ চৌধুরী, মওছুফ আহমদ চৌধুরী, মাহবুব আহমদ চৌধুরী, রাজু আহমদ চৌধুরী, ফুফাতো ভাই বাবুল হোসেন, হেলাল আহমদ চৌধুরী, রেহাল আহমদ চৌধুরী তাদের বাড়িঘর দখলের পাঁয়তারা করছে।
এই অবস্থায় গত ৯ই অক্টোবর তিনি তার ছোট ভাই ওয়াহিদ চৌধুরী, তৌহিদ আহমদ চৌধুরী সিলেট শহর থেকে ট্রাকযোগে মালপত্র নিয়ে পিতার বাড়ি মেওয়া গ্রামে যান। এ সময় ঘরে মালপত্র রাখতে বাধা দেন চাচাসহ অন্যরা। বাধা উপেক্ষা করে তারা ঘরে মালপত্র রাখেন। এ সময় তাদের প্রাণে মারার হুমকি দেন চাচা সহ অন্যরা। এই হুমকিতে তারা তিন ভাই ভীতসন্ত্রস্ত হন। এবং জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করার জন্য বিয়ানীবাজার থানায় যান। প্রথমে ডিউটি অফিসার হালিমের কাছে গিয়ে জিডির কথা বললে তিনি জিডি করার জন্য টাকা দাবি করেন। পরে এ বিষয়টি নিয়ে তিন ভাই বিয়ানীবাজার থানার ওসি (তদন্ত) জাহিদুল হকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু ওসি জাহিদুল হকও জিডি দায়ের করা বাবদ ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। এ সময় তাহমিদ জিডি করতে কেন টাকা লাগবে প্রশ্ন করলে রেগে যান ওসি জাহিদুল। তিনি মিথ্যা মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে তাদের থানা থেকে বের করে দেন। এদিকে, পুলিশের এ আচরণে মনঃক্ষুণ্ন হন তিন ভাই। তারা পুলিশি আচরণের প্রতিবাদ না করে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মেম্বার ও এলাকার মানুষের দ্বারস্থ হন। এ সময় মেম্বার সহ স্থানীয়রা বিষয়টি সামাজিকভাবে সালিশ বৈঠকে মীমাংসা করার আশ্বাস দেন। এ ঘটনার পর ১০ই অক্টোবর বিয়ানীবাজার থানার এসআই রতন তাদের বাড়িতে এসে তাহমিদসহ তিন ভাইকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাহমিদের পকেটে থাকা ২০ হাজার টাকা মওছুফ আহমদ চৌধুরী নিয়ে যান।
তাহমিদ পুলিশ সুপারের কাছে আবেদনে জানান, তার চাচা ছিনিয়ে নেয়া ২০ হাজার টাকা। পরবর্তী সময়ে এসআই রতনকে উৎকোচ হিসেবে দেন। আর ওই টাকা পেয়ে থানা হাজতে নিয়ে তাদের বেধড়ক মারধর করা হয়। এবং ওই রাতে একটি মামলা দায়ের করে তাদের তিন ভাইকে আদালতে পাঠানো হয়। তিনি জানান, ‘চুরির মামলা দায়ের করে আমাদের তিন ভাইকে শুক্রবার বন্ধের দিন আদালতে পাঠানো হয়। আমরা তিন ভাই ছাত্র। এই মামলায় তিনদিন আমাদের কারাগারে থাকতে হয়। এরপর আদালত জামিন দেন।’
তাহমিদ বলেন, ‘রাতভর থানা হাজতে কাঠের রুল দিয়ে তাদের তিন ভাইকে পেটানো হয়। ছোট দুই ভাইকে পেটানোর সময় তিনি গিয়ে ওসি (তদন্ত) জাহিদুলের পায়ে ধরেন। এতে রেগে গিয়ে তিনি আরও পেটান। ওসির পেটানো শেষ হলে এসআই রতন গিয়ে তাদের পেটাতেন। পরের দিন হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে তাদের সিলেটের আদালতে পাঠানো হয়। বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ কীন ব্রিজের দক্ষিণ অংশ দিয়ে তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে হেঁটে হেঁটে নিয়ে আসে। এ ঘটনায় তারা তিন ভাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শুধু টাকার জন্যই পুলিশ তাদের সঙ্গে এ আচরণ করেছে।’
এদিকে, ১০ই অক্টোবর বিয়ানীবাজার থানা ওই তিন ভাইয়ের ওপর চুরির মামলা দায়ের করেন চাচা মকছুদ আহমদ চৌধুরী। মামলায় তিনি তার আপন তিন ভাতিজাকে আসামি করেছেন। মামলায় তিনি জানান, তার ভাই মাহমুদ ১৪ বছর আগে রুমানাকে ডিভোর্স দেন। এরপর থেকে তিন ভাই মা রুমার সঙ্গে উপশহরে বসবাস করছে। তার ভাই মাহমুদ তার অংশের ভূমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে। গত ৯ই অক্টোবর তাহমিদসহ আসামিরা তার বসতঘর দখল করতে যায়। এ সময় তারা ২০ হাজার টাকার ক্ষতিসাধন ছাড়াও ৫ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যায়। পুলিশ ওই মামলা রেকর্ড করে তিন ভাইকে আদালতে প্রেরণ করে।
থানা হাজতে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিয়ানীবাজার থানার ওসি (তদন্ত) জাহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘তাহমিদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা একটি মামলার ওয়ারেন্ট ছিল। এ ছাড়া যাদের ঘর দখল করা হয়েছিল তারাও মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এ সময় তাদের ধরতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এরপরও ওরা বয়সে ছোট থাকায় মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা পুলিশ এসল্ট মামলা দেইনি। নিয়মিত মামলায় আইন মোতাবেক তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেন ওসি তদন্ত।’