শিশুদের একটি অংশ এখনও বিদ্যালয়ের বাইরে রয়ে গেছে। আরেকটি অংশ আছে যারা বিদ্যালয়ে গিয়েও শিখতে পারছে না। এরাই হচ্ছে শিখনবঞ্চিত। শিখনবঞ্চিত শিশুদের হার নির্ণয়ে একটি মানদ- ব্যবহার করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো, যার নাম দেয়া হয় ‘লার্নিং পভার্টি’ বা শিখন দারিদ্র্য। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫৮ শতাংশ শিশুই শিখন দারিদ্র্যের শিকার। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিখন দারিদ্র্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ‘এন্ডিং লার্নিং পভার্টি : হোয়াট উইল ইট টেক’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু এখনও বিদ্যালয়ের বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া বিদ্যালয়গামী একজন শিক্ষার্থীর যা শেখার কথা, তার ন্যূনতমও শিখতে পারছে না ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ‘লার্নিং পভার্টি’ বা শিখন দারিদ্র্যের হার ৫৮ শতাংশ।
জরিপের ফলে শিক্ষার যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। অথচ শিখন দারিদ্র কমিয়ে আনার বিষয়টি এসডিজি ৪-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ শিখন দারিদ্র না কমলে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হবে না। এটা জেনেও সরকার কেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না সেটাই প্রশ্ন।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে মূলত জাতীয় পর্যায়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার গত কয়েক বছরের মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও একই চিত্র পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম মূল্যায়নে প্রতি দুবছর পরপর ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট (এনএসএ) শীর্ষক জরিপ চালায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগ। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এনএসএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণীর ৯০ শতাংশ শিশুই গণিতে দুর্বলতা নিয়ে বের হয়। বাংলায় দুর্বলতা নিয়ে বের হয় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী। চলতি বছর প্রকাশিত সর্বশেষ এনএসএ জরিপেও অনেকটা একই চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণীর ২৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতে মৌলিক জ্ঞানই নেই। আর তৃতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর গণিতে ন্যূনতম যে জ্ঞান থাকার কথা, ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীরই সেটি নেই। অন্যদিকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতে মৌলিক জ্ঞানই নেই। আর একজন শিক্ষার্থীর গণিতে ন্যূনতম যে জ্ঞান থাকার কথা, ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থীরই সেটি নেই।
বাস্তবতা হল, ভালো এবং উপযুক্ত ও দক্ষ শিক্ষক না থাকায় এমনটি হচ্ছে। শহর অঞ্চলের বিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক থাকায় সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সও ভালো। আবার অন্যদিকে চা বাগান কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে দেখা যাবে, সেখানে ভালো শিক্ষক নেই। শুধু ভালো শিক্ষক নয়, গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসম্মত আধুনিক স্যানিটেশন নেই, পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, সৃজশীলতার বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা নেই, লাইব্রেরি নেই, গবেষণাগার নেই, শিখন কার্যক্রমকে সহজ, সুন্দর, চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় করার জন্য গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষা উপকরণ নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে।
দেশের বিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন করতে করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ উপযোগী হতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের পরিবেশ হতে হবে শিশুবান্ধব ও শিক্ষা বান্ধব। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ না করে তাহলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়মুখী হবে না কিংবা বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে।
সে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্যই সাংস্কৃতিক চর্চা, লাইব্রেরি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের প্রয়োজন। এ জন্য সরকারকে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নত দেশের বাজেটেই সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে। কিন্তু বাংলাদেশে তা হয় না। বরং প্রতি বছরই কোন না কোন কারণ দেখিয়ে বরাদ্দের আনুপাতিক হার কমানো হয়। এ প্রবণতা বন্ধ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের উন্নত ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হলেই বাংলাদেশ সঠিক পথে অগ্রসর হবে। আর তার ব্যত্যয় হলে কোন উন্নয়নই টেকসই হবে না।