দিনক্ষণ বেঁধেই গণরুম সমস্যার সমাধান করতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

দিনক্ষণ বেঁধেই গণরুম সমস্যার সমাধান করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রুমের মেঝেতে সারি সারি বিছানা। উভয় পাশে সারিবদ্ধ ট্রাঙ্ক। রুমের বিভিন্ন কোণ বিভিন্ন জিনিসপত্রে ঠাসা। একটু ফাঁকা জায়গাও চোখে পড়ে না গণরুমে। প্রায় দম বন্ধ করা পরিবেশ। সেখানেই থাকতে হয় ২০ থেকে ২২ জনকে। ঘুমন্ত অবস্থায় একজনের পায়ের সঙ্গে লেগে যায় আরেকজনের মাথা। অনেক সময় ঘুমাতে হয় পালা করে। এমনই চিত্র চোখে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের গণরুমগুলোতে। রোববার (৮ ডিসেম্বর) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, গণরুম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেরই অংশ, তা জানা না থাকলে প্রথম দেখায় হঠাৎ করে ভড়কে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। শুয়ে থাকা, ঘুমিয়ে পড়া সারি সারি শিক্ষার্থীকে দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে, আড়তে ফাইল করে রেখে দেয়া ইলিশ। হয়তো শরণার্থী শিবিরও মনে হতে পারে এ রুমকে। শিক্ষার্থীদের দেখে মনে হতে পারে, উচ্চশিক্ষা নেবে কী, এ দুর্বিষহ অবস্থায় ওরা যে বেঁচে আছে- সেটাই তো যথেষ্ট।

বাস্তবতা হলো, হলের গণরুমের অবস্থা বস্তির চেয়েও খারাপ। এবং এটা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। কেউ কেউ এ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে অন্য কোথাও চলে যান। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই অর্থের অভাবে নিরুপায় হয়ে অবস্থান করেন সেখানে। প্রতিটি হলে ছেয়ে গেছে ছারপোকা মারার ওষুধের বিজ্ঞাপণে। প্রতিটি হলের গণরুমের শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত ছারপোকার সমস্যায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের জোবাইদুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, এত মানুষ একসঙ্গে থাকলে তো ছারপোকা আসবেই। জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, কিছুদিন আগে ছারপোকার স্প্রে করি। ৩ দিন কেউ রুমে ছিলাম না। কিছু দিন ভালো ছিলাম এরপর আবার আগের মতোই। ছারপোকার পাশাপাশি আছে মশা, তেলাপোকার সমস্যা।

অর্থনৈতিক কারণে এবং নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলে থাকেন। গণরুমের শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পূর্বপরিকল্পনা যা-ই থাকুক না কেন, তখন পড়াশোনা আর পরীক্ষা কোনটিই হয় না। তাছাড়া গণরুমে ওঠার পর থেকে রোগব্যাধির সঙ্গেও বসবাস শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের। ডেঙ্গু, চর্মরোগ- যেটাই হোক, রুমের একজনের হলেই তাতে আক্রান্ত হয় অন্য সবাই। নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে অনিদ্রা আর উদ্বেগ। ঘুমানোর জন্য পাতা স্বল্প পরিসরের জায়গাটিতে পড়াশোনা করা যায় না। আবার সেই ঘুমও হয়ে ওঠে সোনার হরিণ, যখন শোবার সময় একজনের পা অন্যজনের মুখে লাগে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান থাকেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। তিনি বললেন, ‘এমন অবস্থায় থাকতে হয় যে, আত্মীয়স্বজন কাউকে আনা যায় না। তারা আমাদের থাকার জায়গা দেখে বিশ্বাসই করবেন না, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের আবাসন ব্যবস্থা এমন হতে পারে! উদ্বাস্তুরাও মনে হয় গণরুমবাসীর চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় থাকে।’ সূর্য সেন হলের সাজিদ হাসান বলেন, আমরা দাসপ্রথায় বাস করছি। আমার মনে হয়, দাসপ্রথার সময়েও দাসদের এর থেকে ভালো স্থানে রাখা হতো। ভালো ব্যবহার করা হতো।

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেশ সেরা মেধাবীরা ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদের স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁয়া, আশা থাকে বুক ভরা। কিন্তু স্বাপ্নিক সে জীবন যখন গণরুম, গেস্টরুম আর সিট সংকটের বঞ্চনায় শুরু হয়; দমে যাওয়া হতাশা তো তখন আসবেই। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে বৈধ সিট দেয়া হয় না। আর এটাই নবীন শিক্ষার্থীদের ছাত্রনেতাদের হাতে নির্যাতন-নিপীড়নসহ নাম না জানা অগণিত সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, বৈধভাবে সিট না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে উঠতে হয়; যেখানে হল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন সম্পর্কই থাকে না। শুধু তাই নয়, কর্তৃপক্ষ জানেও না- কে, কখন, কীভাবে হলে উঠছে। এক শিক্ষার্থী জানান, অন্তত হলে উঠতে প্রশাসনের সাহায্য নিয়েছেন; এমন কাউকে খুঁজে পায়নি সে। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আবাসিক শিক্ষকদেরও মাথাব্যথা নেই। কারণ, শিক্ষার্থীদের দেখ-ভালের যে দায়িত্ব তাদের পালন করার কথা; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটি কার্যকর হয় না। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুরবস্থা দেখে লজ্জা পান না। তারা এটিও বলেন, ‘প্রচারণার অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে আসে না।’

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার জীবন দিয়ে উন্মোচন করে গেছেন যে, দেশের সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলো এখন আর জ্ঞান, গবেষণা, সাহিত্য ও মানবিকতা চর্চার জায়গা নয়। এগুলোতে বরং আবিষ্কৃত হয়েছে শত শত ‘টর্চার সেল’। কিছু কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এও দেখা গেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট ব্যাপারটির কোন অস্তিত্বই নেই। বরং এখানে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। গত ১০ বছরে ততোধিক হল নির্মাণ ও সম্প্রসারণ হলেও মাস্টার্স উত্তীর্ণ অছাত্র, বহিরাগত ও অবৈধদের আনাগোনা রয়েই গেছে প্রত্যেকটি হলে। আর এটিই নবীন শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমের শিক্ষার্থীরা গত ২৯ অক্টোবর ভিসির বাসভবনের সামনে প্রতীকী গণরুম বানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন। পরে প্রথম বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সিট দেয়া হবে বলে ভিসির এমন আশ্বাসে তারা অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন। কিন্তু তিনিই আবার আরেক বক্তব্যে বলেন ‘গণরুম সমস্যা এত দীর্ঘদিনের যে, দিনক্ষণ বেঁধে এর সমাধান করা সম্ভব নয়।’ এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হল, ছাত্রদের সিট সংকট যেমন দীর্ঘদিনের তেমনি এক্ষেত্রে আশ্বাসের বাণী নিঃসরণের কাজটিও নতুন নয়। এবং এভাবেই সমস্যাটিকে এড়িয়ে গিয়ে ছাত্রদের দুর্ভোগ বাড়ানো হয়েছে।

ভিসি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ অভিভাবক। অথচ তিনি শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের সমাধান করতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা মানবেতর জীবনযাপন করবে আর তিনি রাজকীয় প্রাসাদে আয়েশে থাকবেন, এটি কোনভাবেই অভিভাবকসুলভ কোনো কাজ বা আচরণ হতে পারে না। আমরা জানতে চাই, সংশ্লিষ্টরা কি এটার সমাধানে কাজ করছেন, নাকি ভাবছেন ‘ছাত্রজীবন ফুলশয্যা নহে, রাস্তায় ঘুমাইলে ক্ষতি কি?’ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যানদের বিলাসবহুল গাড়ির টাকা বাঁচিয়ে দেশের আগামীর কর্ণধার শিক্ষার্থীদের জন্য কী কিছু আবাসিক হল বানানো যায় না? নীতিনির্ধারকদের জন্য যে দেশে নিশ্চিন্ত জীবনের ব্যবস্থা, ধৈর্যশীল ছাত্ররা সেখানে কী শুধুই আশ্বাসের বানী প্রাপ্ত হবেন? তাদের জন্য রাষ্ট্রের কী কোন দায়বদ্ধতা নেই?

উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হতে একজন শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। এতসব সংগ্রামের পর ক্যাম্পাসে আসা নবীনদের পাশে পুরোনো শিক্ষার্থী তথা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সহমর্মী হয়ে পাশে দাঁড়াবে; সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এর উল্টোটা হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাজীবন শুরুর প্রথম ধাপেই হোঁচট খেতে হচ্ছে তাদের, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের এগিয়ে আসা বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে পরিকল্পিত কর্মকৌশল গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। আশ্বাস নয়, কাজের কাজটি করে দেখাতে হবে। বেশ কয়েকটি হল সম্প্রসারণ, নতুন হল নির্মাণ- এসব হচ্ছে এর স্থায়ী সমাধান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সেভাবেই উদ্যোগ নিতে হবে। হল প্রশাসনের মাধ্যমে সিট বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। বহিরাগত সন্ত্রাসী, অছাত্র ও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিয়ে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের সিট দিতে হবে। এতেও আবাসন সমস্যার সমাধান না হলে ছাত্রী হলের মতো ‘দ্বিতল বিশিষ্ট বিছানা’র ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

খন্দকার মুনতাসীর মামুন : সাংবাদিক।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039420127868652