দুঃখিনী বর্ণমালার মুক্তি নেই - দৈনিকশিক্ষা

দুঃখিনী বর্ণমালার মুক্তি নেই

আমিরুল আলম খান |

মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগ প্রবল। কিন্তু চর্চায় তার ভীষণ অরুচি। গানে আর কবিতায় বাংলা নিয়ে নাকি কান্না বেশুমার। কিন্তু জীবনের প্রতিদিনের ব্যবহারে সে একেবারেই অচ্ছুৎ। তাকে নিয়ে আসর গুলজার করা যায়, স্থান তার বড়জোর বৈঠকখানা পর্যন্ত। কিন্তু ঘরের ভেতর তার আসন নেই। মনের গভীরে অস্বস্তির শেষ নেই। কবিতা গানের ভাষায় তো পেট ভরে না। পেট ভরে কেজো ভাষায়। সেটা, কে না জানে, ইংরেজি। তাই ইংরেজি শেখায় বাঙালির প্রাণান্ত চেষ্টা। এককালে ইংরেজি ছিল উচ্চ কোটির সম্পত্তি। এখন গাঁ-গ্রামের দীনহীন মানুষেরও স্বপ্ন ভুলভাল কিছু ইংরেজি শেখা। তাতেই নাকি রুটিরুজির ব্যবস্থা সম্ভব। দেশ স্বাধীন হলে কী হবে? মনোজগতে উপনিবেশের অবসান হয়নি।

শুরুটা ব্রিটিশ বেনিয়ার রাজদণ্ড গ্রহণেরও আগে থেকে। কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৩৪-১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৫২ জন স্থানীয় হিন্দু ব্যবসায়ী নিয়োগ দিয়েছিল। উমিচাঁদ, গোপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, শোভারাম বসাক, লক্ষ্মীকান্ত প্রমুখ পলাশি যুদ্ধের বহু আগেই দাদনি ও দালালি করে ধনশালী হন। ইংরেজের সাথে ব্যবসা করে বনেদি বড়লোক হওয়ার গরজে প্রথম ইংরেজি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। উমিচাঁদ তো কলকাতায় ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দেই ইংরেজি স্কুল খুলে শিক্ষাবাণিজ্যই শুরু করে দেন। জয় নারায়ণ ঘোষ, মহারাজ নবকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ মিত্র প্রমুখ কোম্পানির বেনিয়ানরা ছিলেন প্রথম ইংরেজি জানা বাঙালি। এরাই এদেশে কোম্পানির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন।

খ্রিষ্টান পার্দি চার্লস গ্র্যান্ট আর উইলবারফোর্সের বারংবার তাগিদে ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতীয় প্রজাদের শিক্ষাভার গ্রহণে একটি সনদ প্রণয়ন করে। বছরে এক লাখ টাকা খরচ করতে কোম্পানিকে নির্দেশ দেয় পার্লামেন্ট। গ্র্যান্ট ইংরেজি ভাষায় খ্রিষ্টবিদ্যা প্রসারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। যদিও ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে মেকলের শিক্ষা মিনিট রচনা ও গভর্নর জেনারেল লর্ড বেঙ্কটিং-এর অনুমোদনের আগ পর্যন্ত সে নির্দেশ পালন করেনি কোম্পানি।

১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি রাজভাষা হিসেবে ঘোষণার পর এদেশে ইংরেজি শিক্ষার অফিসিয়াল যাত্রা শুরু হয়। ঊনিশ শতকের বাঙালি পুরোধা পুরুষরা ইংরেজি প্রেমে মত্ত ছিলেন। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সকলেই ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই ভারতবাসীর মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। কলকাতার বাবু আর শাসক ইংরেজদের বয়ানে কোম্পানি শাসন ছিল মধ্যযুগীয় যবনীশাসন থেকে মুক্তির একমাত্র নিদান। দ্বারকানাথের মতো বড় বড় জমিদারেরা মিটিং করে প্রিভি কাউন্সিলে আরজি জানিয়েছিলেন মহানুভব শ্বেতাঙ্গ, সভ্য ইংরেজ জাতি যেন আমেরিকার মতো এদেশে স্থায়ী বসতি গাড়েন, অন্ধকারে হাবুডুবু খাওয়া ভারতবাসীকে ইংরেজি শিখিয়ে, খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে তাদের ইহকাল-পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করেন।
কলকাতার এ মহান ব্যক্তিরা যখন ইংরেজ, ইংরেজি ভাষা প্রেমে মত্ত তখন ‘অশিক্ষিত’ মঙ্গল পান্ডেরা হাতে অস্ত্র তুলে ইংরেজ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। পলাশী যুদ্ধের শতবর্ষ পর ভারত জুড়ে সে বিদ্রোহ কোম্পানির রাজত্ব খতম করে দিয়েছিল। দেউলিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ মহারানীর কাছে বেচে দেয় অধিকৃত ভারত। এসব ঘটনা ভারতের পরাধীনতার অবসান না হলেও জাতীয়তাবাদী শক্তির উন্মেষ ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়েই ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ সবাইকে অবাক করে হিন্দির পক্ষে মত দেন। অপরদিকে, আজাদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বাংলার পক্ষে জোরালো  যুক্তি উত্থাপন করেন। কিন্তু ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দেই জিন্নাহ উর্দুর পক্ষে বক্তব্য দিলে বাঙালিরা তা মানতে অস্বীকার করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যান। বায়ান্নোর এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। স্বাধীনতার বেদিতে উৎসর্গিত হয় ৩০ লাখ প্রাণ। সংবিধানে লেখা হল বাংলা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রের সকল কাজ পরিচালিত হবে বাংলায়। কিছু তোড়জোড়ও দেখা গেল চারিদিকে। কিন্তু বেশিদিন সে আবেগ কাজ করল না। ইংরেজি প্রীতি নতুন জোয়ারে ফিরে এলো। অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকল দুঃখিনী বর্ণমালার বাংলা ভাষা। রাজধানী ঢাকায় উঠতি ধনিক শ্রেণির সন্তানদের জন্য স্থাপিত হল ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। গ্রিক, লাতিন, ইংরেজি নামের আড়ালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত সে সব স্কুলে কট্টর বাঙালিদের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। পকেট ভরা লুটের পয়সা তাদের। জামাতিরাই ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রত্যেক থানায় অন্তত একটা করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খুলে বাঙালিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রজেক্ট এগিয়ে নিল নব্য ধনী কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাঁধে চড়ে। 

আসর জমালো নানা নামের বহু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। উইলস লিটিল ফ্লাওয়ার, সান বীম, গ্রিন হেরাল্ড, সানিডেল, স্কলাস্টিকা, মেন্টর, একাডেমিয়া, লাইসিয়াম, এজি চার্চ, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল, অর্কেডিয়া, কার্ডিফ, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কর্ডোভা, ডন বস্কো, লকহিড গ্রামার, লন্ডন গ্রেস, মাফল লিফ, মাস্টার মাইন্ড ইত্যাদি হরেক মনভুলানো বাহারি নামের স্কুল। সেখানে শুধু ভর্তি করতেই লাখ লাখ টাকা খরচ করেন ধনী বাবা-মায়েরা।

পিছু পিছু কলেজ ফর ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ ইত্যাদি। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে সরকার দোজখের  দরজা খুলে দেয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়ে। দেশে এখন শ’ দেড়েক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে বাংলা ভাষার প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ। এদিকে, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলা স্রেফ ‘খেত’ ছাড়া আর কিছু নয় কি?

এসব স্কুলে ধনিক শ্রেণির সন্তানেরা পড়ে। ততদিনে বাঙালির বিদ্যাবাণিজ্যে জ্ঞান বেশ পেঁকে উঠেছে। রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় বড় শহর, পরে জেলা ছাপিয়ে উপজেলায় পৌঁছে গেল। দেশের অর্থনীতি যত লুটসর্বস্ব হয়ে উঠল, রাজনৈতিক টাউটরা যত ক্ষমতাদর্পী হবার রাস্তা খুঁজে পেল, ঠিকাদারি যখন অবাধ লুণ্ঠনের মৌরসি পাট্টা হল তখন গ্রামের সম্পন্ন কৃষক, ইউনিয়নের মেম্বার, চেয়ারম্যান, মাঝারি ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, সিএন্ডএফ এজেন্ট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সন্তানদের জন্য সরকারের প্রাইমারি স্কুল, এমপিও দেয়া হাই স্কুল বা কলেজকে আর তাদের সন্তানের জন্য উপযুক্ত ভাবতে পারল না। এর সাথে যুক্ত হল রেমিটেন্সের টাকাওয়ালারাও।

মেকলের চুঁইয়ে পড়া তত্ত্ব ফল দিতে শুরু করল। বড় শহর ছাপিয়ে ছোট ছোট শহর, এমন কি অজপাড়া গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল। গ্রামে গ্রামে যত বাংলা স্কুল, তার সাথে পাল্লা দিয়ে গজিয়েছে কিন্ডারগার্টেন। গালভরা নাম তাদের। কারো গায়ে অক্সফোর্ড, কারো গায়ে হার্ভার্ডের নাম জ্বল জ্বল করে। কোনোটা গ্রামার স্কুল, কোনোটা বা ইন্টারন্যাশনাল। সারা বাংলায় এখন ব্রিটিশ, আমেরিকান স্থাননামের জয়জয়কার। এরা কেউ স্বদেশী বই পাঠ্য করে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে কলা দেখিয়ে তারা বিদেশি বই পড়ায়। সেখানে না পড়ানো হয় বাংলা, না ইংরেজি। পাতি-শিক্ষিত একদল তরুণ-তরুণী ইংরেজি শেখানোর নামে লগ্নিকারীর অর্থ লোপাটের সাঙ্গাত সেজেছে।

এখানেই শেষ নয়, আমাদের অসীম ক্ষমতাধর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেখানে প্রবেশাধিকারও নেই। সরকারর চিঠিপত্র গ্রাহ্যে আনে না এসব স্কুল। নোংরা আবর্জনার মতো ফেলে দেয়। এমন কি মহাক্ষমতাধর রাজকর্মচারীদেরও তাদের অন্দরমহলে কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এই একটি ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপুরুষরা অসহায় বটে। অথচ সারা দেশে এসব ইংরেজি স্কুলের দামি দামি সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে। তাহলে তার সংখ্যা অন্তত গুণে বের করা গেল না কেন? উত্তর সোজা। সরকারের লোকদের কাছে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চেয়ে এসব স্কুলের কদর বেশি।

স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাভাষা এখন দুয়োরানী। পালঙ্কে শুয়ে সুয়োরানী ইংরেজি। গ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবখানে ইংরেজি চর্চা। খোদ সরকার বাহাদুর ক্লাস থ্রি থেকে সব বই ইংরেজি ভার্সনে পড়ানোর আইন করে বাংলা চর্চার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছেন।
তাহলে শুধু ফেব্রুয়ারিতে বাংলাভাষার কেত্তন গেয়ে লাভ কী?

লেখক : আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068390369415283