দুদকের নজরদারিতে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ৪৩ শিক্ষক - দৈনিকশিক্ষা

দুদকের নজরদারিতে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ৪৩ শিক্ষক

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি |

কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন চট্টগ্রাম মহানগরের নামকরা ৯টি সরকারি স্কুলের ৪৩ শিক্ষক। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থেকে অবৈধভাবে প্রতি মাসে বাড়তি কয়েক লাখ টাকা আয় করেন এই শিক্ষকরা। তাদের বেশিরভাগই ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক। এবার তাদের নজরদারিতে আনছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযুক্ত শিক্ষকদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে তারা। অবৈধভাবে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে আয় করা, ব্যক্তিগতভাবে কোচিং স্কুল পরিচালনাসহ নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের টিম মাঠে নামছে। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করতে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) চট্টগ্রাম। অভিযুক্ত শিক্ষকদের অনেকে শাস্তি কিংবা বদলি থেকে বাঁচতে গোপনে চালাচ্ছেন জোর তদবির-লবিং। অনেকে মন্ত্রী-এমপি দিয়েও সংশ্লিষ্টদের করাচ্ছেন ফোন ও সুপারিশ। অনেকে আবার দিচ্ছেন নানাভাবে হুমকি-ধমকি। শিক্ষকদের এমন আচরণে বিব্রত সংশ্লিষ্টরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, চট্টগ্রামের বিশ্বস্ত ৯টি সরকারি স্কুলের ৪৩ শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে শিক্ষকতার পেশাকে কলঙ্কিত করেছেন। বাড়তি আয়ের লোভে শিক্ষকরা হাইকোর্টের আদেশ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকেও মানেননি। এমন অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে নানাভাবে ক্ষমতাধর বনে গেছেন তারা। তালিকায় নাম চলে আসায় এখন তারা গোপনে শুরু করেছেন নানা তৎপরতা। শাস্তি থেকে বাঁচতে ও বদলি ঠেকাতে অনেকে মন্ত্রী-এমপিকে দিয়ে করাচ্ছেন ফোন ও সুপারিশ। তবে কোনো কিছুই তাদের রক্ষা করতে পারবে না। দুদকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এসব শিক্ষককে নজরদারিতে আনলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। ৪৩ শিক্ষকের অপকর্মের যাবতীয় তথ্য দিতে আমরা প্রস্তুত।

তিনি আরও বলেন, তালিকায় নাম আসায় কয়েকজন শিক্ষক পাগল হয়ে গেছেন। নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। আমাকে দেখে নেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কয়েক শিক্ষক স্ত্রী-সন্তান অসুস্থ থাকার কাগজপত্র, এমনকি স্ট্রেচারে ভর করে অভিনয়ের আশ্রয় নিয়ে আমার কাছে এসেছেন।

দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, যুগের পর যুগ একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা ৪৩ শিক্ষকের যাবতীয় বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এই শিক্ষকদের কার কতটি ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টার কিংবা স্কুল আছে, দেখা হবে তাও। মাসিক বেতনের বাইরে কোনো শিক্ষকের বাড়তি আয় কত এবং এই আয়ের উৎস কী, তাও খতিয়ে দেখা হবে। দুদকের একটি টিম মাউশি চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে এই শিক্ষকদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। সার্বিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর একটি  প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।

আরও পড়ুন: সরকারি স্কুলের ৪৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আবু হাসান সিদ্দিক বলেন, নামকরা স্কুলের শিক্ষকরাও যদি অবৈধভাবে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তবে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? অনেক বছর ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকায় এমন অপরাধ করার সাহস পেয়েছেন শিক্ষকরা। ৪৩ শিক্ষক যা করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের ব্যাপারে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে। শিক্ষকদের এমন আচরণে আমরা বিব্রত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তালিকায় নাম আসা ৪৩ শিক্ষকের মধ্যে বেশ কয়েকজনের ব্যক্তিগত কোচিং সেন্টার ও স্কুল রয়েছে, যা থেকে তারা অবৈধভাবে প্রতি মাসে আয় করেন কয়েক লাখ টাকা। কয়েকজনের বড় ভাই ও আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন শিক্ষা খাতের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন দায়িত্বে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে ম্যানেজ করে এই শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ কোচিং বাণিজ্যও। কোনো কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কিংবা ব্যবস্থা নিতে চাইলে ওপর থেকে ফোন করে হুমকি দেয়া হয়। অনেককে আবার টাকা দিয়েও ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শিক্ষকদের কেউ কেউ। কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়টি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা জানেন। কিন্তু নানাভাবে ক্ষমতাধর হওয়ায় তারাও ভয়ে কখনও মুখ খোলেননি। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা কয়েকবার চাওয়া হলেও কেউ জড়িত নেই বলে সাফ জানিয়ে দিতেন প্রধান শিক্ষকরা। অভিযোগ আছে, প্রধান শিক্ষকদের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা।

প্রধান শিক্ষক প্রসঙ্গে উপপরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়টি আগে থেকেই জানতেন নিজ নিজ স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা। কিন্তু আমরা যখনই জড়িতদের তালিকা চাই, বলা হয় কেউ জড়িত নয়। এমন অনিয়মের জন্য প্রধান শিক্ষকরাও দায়ী। কয়েকজন প্রধান শিক্ষককে বর্তমানে বদলি করা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। অনেক বছর ধরে চট্টগ্রামে নানাভাবে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকরাই মাউশির উপপরিচালকের দায়িত্বে এসেছেন। যে কারণে তারা কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানা ও পাওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেননি।

শিক্ষাবিদদের মতে, এই ৪৩ শিক্ষক এ পেশাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছেন। এর মাধ্যমে তারা পুরো শিক্ষক সমাজের মুখে চুনকালি দিয়েছেন। অনেকদিন পর হলেও তাদের নাম যেহেতু তালিকায় এসেছে, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কোচিং বাণিজ্য করে কে কত টাকার মালিক হয়েছেন, তাও খুঁজে বের করা উচিত দুদকসহ সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

চলতি মাসে ৪৩ শিক্ষকের নাম, পদবি, অপকর্মের বিস্তারিত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চিঠি দেয় মাউশি চট্টগ্রাম কার্যালয়। সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী একই প্রতিষ্ঠানে তিন বছরের বেশি চাকরি না করার বিধান থাকলেও ৪৩ শিক্ষকের বেশিরভাগই একই কর্মস্থলে আছেন ১০ থেকে ২৮ বছর ধরে। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মাউশি এই শিক্ষকদের বেশ কয়েকবার সতর্ক, এমনকি শোকজও করেছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই তারা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করেননি। অভিযুক্ত শিক্ষকদের দুদকের নজরদারিতে আনার খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।

কয়েকজন অভিভাবক বলেন, দোষী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এত বড় অপরাধ করেও যদি তারা পার পেয়ে যান, তবে আগামীতে অনেকে একই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত হবেন। আর তা হলে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অসাধু শিক্ষকদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকতে হবে।

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011267900466919