দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার - দৈনিকশিক্ষা

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার

ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া |

দেশে মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। যদিও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছে। দেশে মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩২.২ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার শিকার। আজ বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সচেতন করার জন্য ১৯৫১ সালের ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার প্রথম ১৯৫১ সালের ১৫ অক্টোবরকে সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবস ঘোষণা করেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় ও নিরাপদে পথ চলতে এবং সচেতনতা বাড়াতেই এ দিবসের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকারের বিবিধ উদ্যোগের মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জীবনমান উন্নয়নে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটি’। আইসিটি হলো নতুন শতাব্দীর এক আলোচিত এবং সময়োপযোগী ধারণা। এই ধারণা দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধিতাসহ উন্নয়নের প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে আইসিটির বহুমুখী প্রয়োগের বিপুল সম্ভাবনা বিদ্যমান। প্রতিবন্ধী মানুষের সুনির্দিষ্ট তথ্য ও যোগাযোগ চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে যথাযথ ও সচেতনভাবে আইসিটি ব্যবহার করা গেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের টেকসই উন্নয়নে প্রযুক্তির প্রসার ও প্রয়োগ হতে পারে এক কার্যকর হাতিয়ার। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এখন শুধু সাদাছড়ি আর হুইলচেয়ার নয়, প্রয়োজন তাদের হাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন।

এই অধিকারের কথা জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ’-এর ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’-এ উল্লেখ রয়েছে যে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থা কর্তৃক গণমাধ্যম, ইন্টারনেটসহ অন্যান্যভাবে সর্বসাধারণের জন্য প্রচারিত সব তথ্য ও সেবা, যথোপযুক্ত ব্যবহার উপযোগী পদ্ধতি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রাপ্তির নিমিত্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এ উপলক্ষে তথ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা।’ দেশে বর্তমানে ২৪ হাজারের মতো ওয়েবসাইট আছে, তবু একটি ওয়েবসাইটও পরিপূর্ণভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী নয়। তবে আশার কথা, সরকার এ ধরনের একটি নীতিমালা প্রণয়নের চিন্তা করছে।

গত তিন দশকে সারা বিশ্বে আইসিটির বিপুল অগ্রগতি হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপকভাবে এর সুবিধা গ্রহণ করতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের ইনফরমেশন অ্যান্ড সলিউশন গ্রুপ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ওয়েব ব্যবহার, সফটওয়্যার, বার্তা যোগাযোগ ও শিক্ষায় ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ কথা এখনো অনেকাংশে সত্য। তবে বর্তমান সরকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চলাচল ও শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহারে কিছুটা সহজগম্যতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশে ব্রেইল (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের লিখন পদ্ধতি) উৎপাদনে কম্পিউটারের ব্যবহার, ডিজিটাল টকিং বুক বা কথা বলিয়ে বই এবং কম্পিউটারের পর্দার লেখা পড়তে পারে এমন সফটওয়্যার যেমন ই-টেক্সট ও মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক ক্লাসরুম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ ছাত্র-ছাত্রী ২৩ হাজার ৫০০ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে অংশ নিচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই ইতিবাচক উদ্যোগগুলোর কত ভাগ সুফল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে? এসব ডিজিটাল পাঠ উপকরণ দৃষ্টি ও মুদ্রণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব করা গেলে তাদের জীবনে আসতে পারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিক্ষা প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়। সব ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নোঙর সমাজের বুক থেকে উপড়ে শিক্ষা মুখ্য ভূমিকা পালন করে; কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, বিশ্বব্যাংক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ শিশু স্কুলগামী; যেখানে মোট প্রতিবন্ধী শিশু ৩.৫ মিলিয়ন। আমাদের দেশে মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৩২ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং এদের বড় একটি অংশ স্কুলগামী উপযোগী শিশু। কম্পিউটারভিত্তিক বহুমাত্রিক মাধ্যমের সুবিধা প্রাপ্তি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বেশির ভাগ শিশুকে শিক্ষা ও শিক্ষা-পরবর্তীতে কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ হতে পারে একটি অন্যতম উপায়। ঘরে বসে ওয়েবসাইট তৈরি, গ্রাফিকস ডিজাইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ফ্রিল্যান্সিং কিংবা অফিসে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও কম্পিউটারে অফিস প্যাকেজের ব্যবহার, তথ্য ও যোগাযোগে ইন্টারনেট, ই-মেইল, ফেজ বুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো সহজে ব্যবহার করে শিক্ষা ও কর্মে উভয় জায়গায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা টেকসই উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম হবে।

বর্তমান যুগ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগ। এ যুগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করছে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সর্বশেষ ৯১তম রাষ্ট্র হিসেবে ২০০৭ সালের ৯ মে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদ অনুস্বাক্ষর করার পর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এগিয়ে চলেছে। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সব ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও আইসিটি সেক্টরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনো জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পৃক্ত হয়েছে, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে বলে তাদের আশাতীত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের লক্ষ্যে কয়েক যুগ আগে থেকে কাজ শুরু হলেও আইসিটি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে কম। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আরো অধিক পিছিয়ে। 

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা এবং শিক্ষা ও চলাচলে সহায়ক তথ্য-প্রযুক্তি বা আইসিটির অসাধারণ অগ্রগতি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা ও চলাচলে এক ডিজিটাল বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ যেমন অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, ঠিক তেমনি প্রযুক্তি সহায়ক বিভিন্ন ডিভাইস থেকেও অনেকাংশে বঞ্চিত। তবে বর্তমান সরকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা শিক্ষাব্যবস্থা, যোগাযোগ ও চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0096380710601807