আমরা মানসম্মত শিক্ষার কথা বলি, মানসম্মত শিক্ষা আমাদের দেশের অগ্রগতি ও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষাই প্রয়োজন। আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা চলছে, শিক্ষা কিন্তু এর বাইরে নয়। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই নাজুক হচ্ছে। সবাইকে মিলিয়েই এই অস্থিরতা ও ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য আমাদের বিভিন্ন রকম শিক্ষাব্যবস্থাও কম দায়ী নয়। আমাদের সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে মানসম্মত শিক্ষার ওপর।
একসময় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় নির্দিষ্ট বিষয়ে বাঁধাধরা কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করলেই পাস করা যেত। কয়েকটি উত্তর মুখস্থ করলে পরীক্ষায় কমন পাওয়া যেত বলে অনেকে মনে করত। তবে কয়েক বছর আগে এই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে নিয়ে আসা হলো সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। এই পদ্ধতির আওতায় এখন আর উত্তর মুখস্থ করার সুযোগ নেই, পুরো বই পড়তে হয়। সম্পূর্ণ বিষয় ভালোভাবে না জানলে চলে না, শিক্ষার্থীদের জেনে তারপর নিজের মতো করে উত্তর তৈরি করতে হয়। তবে এ শিক্ষা মানসম্মত কি না তা বলার সময় এখনো আসেনি। এখন সংক্ষিপ্ত বা শর্টকাট রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়। পুরো বই পড়ার দরকার পড়ে না। নির্ধারিত অবয়বে ছকবাঁধা পড়াশোনা করলেই পাস করা যায়।
তারপর আবার রাজনৈতিক কারণে শিক্ষা ও ফলাফলে বিস্ফোরণ দেখাতে হবে—এমন অলিখিত নির্দেশ আসে একেক সরকারের আমলে। ফলে যেকোনোভাবেই গ্রেড ভালো চাই, শিক্ষার্থী কী শিখল আর না শিখল তাতে কিছু যায় আসে না। শৈশব অচেনা হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যস্ত খারাপ ফলাফলের কারণে যাতে কারণ দর্শাতে না হয় সে জন্য এবং তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। অথবা সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকতেই হবে—এই অঙ্গীকারের জন্য। তাই স্বাভাবিক নিয়মে শিক্ষাকে আনন্দময় করার দরকার নেই। পুরো বই পড়ে জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন নেই। ভালো করার জন্য ছকে ঢুকতে হবে, পরীক্ষাই সব।
তবে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। সৃজনশীলতা চর্চার বদলে শিক্ষার্থীরা এখনো মুখস্থবিদ্যায় ভর করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়। ভাবাই যায় না! ফলে শিক্ষাজীবনের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও অনেক শিক্ষার্থী অন্তঃসারশূন্যই থেকে যাচ্ছে বলে মনে করে অনেকে। যার প্রভাব পড়ছে বাস্তব জীবনে, এমনকি তাদের চাকরি জীবনেও। পাস করে চাকরি পাওয়া যায় না ঠিকমতো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করতে ১৮ বছর লেগে যায়। আর প্রতি শ্রেণিতেই এক বা একাধিক ইংরেজি বিষয়ও থাকে। এর পরও শিক্ষাজীবন শেষ করে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শুদ্ধভাবে ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারে না। অথচ বর্তমানে যেকোনো চাকরিতেই ইংরেজিতে দখল থাকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক চাকরির বিজ্ঞপ্তিতেই অন্যতম শর্ত দেওয়া থাকে—প্রার্থীকে ইংরেজি বলতে, লিখতে ও বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে। এমনকি স্নাতকোত্তর পাস করেও অনেকে শুদ্ধভাবে বাংলাও লিখতে পারে না বলে অনেকে জানিয়েছে।
কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকা, গবেষণার অভাব, নিয়মিত ক্লাস না হওয়াসহ নানা সমস্যা রয়েছে। আর মেধাবী শিক্ষকের অপ্রতুলতা মানসম্মত শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি করে; কিন্তু যাঁরা এই মেধাবী জনসম্পদ তৈরি করেন অর্থাৎ শিক্ষক, তাঁদের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা নগণ্য। ফলাফল, মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না, যা মানসম্মত শিক্ষা উন্নয়নে একটি অন্যতম প্রধান বাধা।
শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থার কথা দেশের বিবেকসম্পন্ন মানুষকে না ভাবিয়ে পারে না। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যজনক অবস্থা ক্রমেই আমাদের গ্রাস করছে, ধ্বংস করছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। শিক্ষা নিয়ে আর হেলাফেলা করার দিন নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। একটি জাতি শিক্ষায় যত উন্নত, সে জাতির উন্নতির মাত্রাও তত বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস না করে, তাদের সঠিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সবার—সেখানে শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি মা-বাবারও দায়িত্ব রয়েছে। নাগরিক সমাজের যেমনি ভূমিকা রয়েছে, তেমনি প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে খারাপ পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তা আমাদের কল্পনার বাইরে। এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসার রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে, এ জন্য প্রয়োজন একটি সম্মিলিত প্রয়াস। আমাদের সমাজে যে অস্থিরতা চলছে, শিক্ষাও কিন্তু এর বাইরে নয়। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই নাজুক হচ্ছে। সবাইকে মিলেই এই অস্থিরতা ও ধ্বংসের হাত থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে। সরকারি দল, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজসহ সমাজের সবার দায়িত্ব রয়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার।
আমাদের জ্ঞাননির্ভর একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক মেধাবী, কিন্তু তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা আমরা দিতে পারছি না। অনেক শিক্ষার্থী উন্নতি করছে তা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতায়। বাণিজ্য আর রাজনীতির থাবা থেকে বের করে শিক্ষা নিয়ে চিন্তার বিষয়টি শিক্ষা গবেষকদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের পরামর্শমতো কাজ করলে আমরা মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করতে পারব। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও থাকা উচিত শিক্ষা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত যোগ্য মানুষদের। তাহলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা জরুরি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য, আমাদের অগ্রগতির জন্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ