দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী ঘটেছে বা ঘটছে - দৈনিকশিক্ষা

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কী ঘটেছে বা ঘটছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন, তাহলে তা সহজে জনগণ জানতে পারেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যতই চেষ্টা করুক না কেন দুর্নীতির ব্যাপারটা ঢাকা দিতে পারেন না। যিনি গোপনে উৎকোচ গ্রহণ করেন, তার ধারণা যেহেতু গোপনীয়ভাবে উৎকোচ নেয়া হয়েছে, তা কেউই জানতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- যিনি উৎকোচ দেন, তিনি ঢোল পিটিয়ে উৎকোচের কথা না বললেও এমনভাবে উৎকোচ প্রদানের ঘটনা নিকটদের কাছে বর্ণনা করেন, তার ঢোল পিটিয়ে বক্তব্য রাখার সামিল। আমাদের ছোটবেলায় অর্থাৎ ৭০-৮০ বছর আগে বলা হতো পুলিশ, খাদ্য বিভাগ ও কাস্টমস দুর্নীতি করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা বিচারালয়ে দুর্নীতি হয় এরূপ কথা শোনা যায়নি। ষাটের দশকে যখন আমি রাজবাড়ীতে একজন চিকিৎসক, তখন ওই শহরের একজন মুনসেফ সন্ধ্যার পর বাড়িতে আত্মীয় কেউ ঢুকতে দিতেন না। নিজে বাজার করতেন। কেননা বাজার করার কোনো লোক ছিল না। বাসায় ছিল না কোনো কাজের বুয়া। এরপর সেশন জজ, বড় বড় ব্যক্তি ও এমনকি প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত ডাক্তার হওয়ার সুবাদে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু ৬০-এর দশকে ওই রাজবাড়ীর মুনসেফের মতো আদর্শের সৎচরিত্রের এমন একজন বিচারকের দেখা আর কখনো হয়নি। আমার প্রয়াত পিতাকে বহুবার বলতে শুনেছি যে, শিক্ষক ও বিচারপতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। তবে সত্য কথা বলতে কি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মতো আজ শিক্ষক ও বিচারক খুঁজে পাওয়া কঠিন। শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, কে না জানে যে, একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষককে নিয়োগ দিতে তিন থেকে সাত লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। আর একজন পুলিশ কনস্টেবলের চাকরিতে ঘুষের পরিমাণ আরও বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলছে অবাধে দুর্নীতি। শোনা যায় একজন লেকচারার নিয়োগ দিতে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা গুনতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট করে উন্নয়ন কাজের কার্যাদেশ প্রদানসাপেক্ষে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য নিয়ে থাকে। সম্প্রতি কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে, অবৈধ লেনদেনের ব্যাপারে যেভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে তাতে উপচার্য সর্বোচ্চ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বলে মেনে নেয়া যায় না। উন্নয়নের টাকা যেভাবে সিন্ডিকেট সদস্যরা ভাগাভাগি করেন এবং ছাত্রনেতা যেখানে জড়িত থাকেন, তা এখন আর অতীতের কোনো ঘটনা নয়। আমার মনে আছে রাজনৈতিক মামলায় আমার পুত্র যখন কারাগারে বন্দি, তখন একজন এডভোকেট যাকে আমি চিনি না, তিনি এসে বললেন সব রাজনৈতিক নেতা এন্টিসেপ্টারি বেল পেয়েছেন। পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করলে আপনার ছেলেকে কালই জামিন পেয়ে যাবেন। আমি বলেছিলাম যে, পাঁচ বছর কারাগারে থাকলেও আমি ঘুষ দিয়ে জামিন নিব না। আমার বিশেষ পরিচিত একজন সেশন জজ একবার কয়েকটা কাঁঠাল নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসলেন। তদবির হল হাইকোর্টের জজ হওয়ার। আমি বললাম, আমি তদবির করি না। পরে দেখলাম দু’বছর পরে স্ফীত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন। কোনো দেশে শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থায় যদি দুর্নীতির কারণে প্রভাবান্বিত হয়, তাহলে সে দেশের ভবিষ্যত কী!

যে কথাগুলো উত্থাপন করলাম, তাতে কোনো বিশেষ একটা দল বা নেতা করেছেন তা নয়। তবে বাস্তবতাটা হচ্ছে যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের এই ক্রিয়াকলাপ করার সুযোগ বেশি থাকে। কিছুদিন আগে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ১০ লক্ষ করে টাকা নিয়ে লেকচারার নিয়োগ দেন। পরে অবশ্য তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু করেছেন, তার সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছেন। এই অভিযান শিক্ষাঙ্গন ও বিচারালয়ে সর্বপ্রথম চালানো উচিত। কি দেখলাম আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়, আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করবার সুবাদে আমাকে যেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপাচার্য ও সিন্ডিকেট কর্তৃক সৃষ্ট দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য। সকলেই জানে স্থানীয়ভাবে শিক্ষক, ছাত্র ও স্থানীয় রাজনৈতিক সকলেই জানেন কারা দুর্নীতি করেন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসের পর মাস বিশৃঙ্খলা চলছে। কিন্তু কেউই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এগিয়ে আসছেন না। কেউ কেউ উপাচার্যের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত আছেন অথবা সংশ্লিষ্ট না হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। শুনলে অবাক হবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন প্রক্রিয়ায় যেধরনের দলাদলি সংঘাত এমনকি সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে, তা কল্পনাতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, এখন অন্তত ৪টাতে প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। ধরে নেওয়া যায় তারা উচ্চমানের বুদ্ধিজীবী, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলে মিলেই সম্মিলিতভাবে একটা কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরক্ত হন। নিজেরাই কোন্দল সৃষ্টি করে ঢাকায় আসেন সমাধানের পথ খুঁজতে।

আমরা বারবার কেন্দ্র থেকে বলে আসছি প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু এই নীতি কার্যকর করা যাচ্ছে না। ওরা আর আমরা এই বিভেদ নীতি কার্যকর রয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখি মূল দ্বন্দ্বের কারণ স্বার্থজনিত ভাগবাটোয়ারা। এটা একান্তই দুঃখজনক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার বা কোষাধ্যক্ষ কি করে ২য় বার এমনকি ৩য় বার নিয়োগ পান, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই এই দায়িত্ব নিতেই হবে। একজন দুর্নীতিবাজ উপাচার্য কি করে পুনরায় নিয়োগ পান সেই রহস্য উদ্ঘাটন করে ঐ প্রক্রিয়া চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের সম্মানজনকভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। ছাত্র সংগঠনসমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার অধিকার থাকবে না।

সম্প্রতি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড ও অসহনীয় আচরণ ঘটছে, তা সত্য-সত্যই কলঙ্কজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, তবে এখনও শিক্ষার মান বাড়েনি। গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এসেছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডকে এখন কী বলে অভিহিত করা হবে তা বলা দুষ্কর। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণামূলক, সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের সুফল জাতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোগ করছে না। একমাত্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থানে আছেন। উদ্ভাবন প্রক্রিয়া অগ্রসরমান রয়েছে। শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিশেষ নজরের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু অর্থ বরাদ্দ করলেই হবে না। সে অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। শিক্ষার প্রকৃতিগত যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা আরও উন্নততর হওয়া দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তি, শৃঙ্খলা, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। সরকারপ্রধান অত্যন্ত সৎ ও সৃষ্টিধর্মী প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তার প্রতিফলন কর্মক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা যাচ্ছে না। আসুন আমরা সকলে মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিচারালয়ে দুর্নীতিমুক্ত করতে সাহায্য করি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানকে সফল করি।

লেখক : ডা. এসএ মালেক, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনীতিক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052869319915771